ঢাকা সুরক্ষায় ড্যাপ

ঢাকা সুরক্ষায় ড্যাপ
নিজস্ব প্রতিবেদক  : ঢাকা মহানগর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বাস্তবায়নকেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, আমলা, ব্যবসায়ী নেতা ও অংশীজনরা।সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, সবাইকে নিয়ে নির্ভুলভাবে ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে চাই।তবে অংশীজনদের অভিযোগ, রাজউকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সমঝোতা অনুযায়ী অংশীজনদের মতামতের কাঙ্ক্ষিত প্রতিফলন এই ড্যাপে নেই।অন্যদিকে আবাসন খাতের শীর্ষপর্যায়ের নেতারা বলেছেন, সময়ক্ষেপণ না করে যত দ্রুত সম্ভব ড্যাপ প্রস্তাবনা আকারে অনুমোদন দিন। পরে প্রয়োজন অনুযায়ী রিভিউ কমিটি সংশোধন, পরিমার্জন, পরিবর্তনসহ সব ধরনের উদ্যোগ নেবে।শনিবার (২০ নভেম্বর) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) আয়োজিত ড্যাপ (২০১৬-২০৩৫) খসড়া পরিকল্পনা নিয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক মো. তাজুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এমপি, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ এমপি, স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন, বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলাপারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) সভাপতি ও দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজলসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনেরা।সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন রাজউক চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী। মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম।স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ডিটেইল এরিয়া প্লান (ড্যাপ) বাস্তবায়নে আপনারা একটি সুন্দর পরিকল্পনা জমা দিয়েছেন, তার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। আমার আরেকটা বিষয় ভালো লেগেছে, আপনারা সবাই যার যার অবস্থান থেকে দেশকে ভালোবাসেন। সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাকে আমরা আনস্টেক (বাধাহীন) করার কাজ করছি। পৃথিবীর অনেক দেশের সিটি করপোরেশনের আয় বেড়েছে। তারা মেট্রোরেল বানিয়েছে। বিমানবন্দর বানিয়েছে, খেলার মাঠ, পার্ক করেছে। আমাদের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে ক্যাপাসিটি ডেভেলপ করতে হবে।সালমান এফ রহমান বলেন, ড্যাপের বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাস্তবায়নে। আশা করি, ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে পারবো। রাজধানীকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। রাজউকের বিরুদ্ধে আমরা অনেক অভিযোগ পাই। রাজউককে দ্রুত ডিজিটালাইজড করা দরকার। রাজউক চাইলে দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব।গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ বলেন, নগর একটি দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। কিন্তু নগরায়ন পরিকল্পিত না হলে তাতে নাগরিক জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। বাংলাদেশে নগরায়নের যে চিত্র তার সিংহভাগই ঢাকাকেন্দ্রিক। রাজধানী শহর হওয়ার কারণে ঢাকার জনসংখ্যা খুবই দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকার জনসংখ্যা হবে ২৬ মিলিয়ন। তখন ঢাকা হবে পৃথিবীর ষষ্ঠ মেগা সিটি। দেশের অন্যান্য শহরের সুযোগ সুবিধার তুলনায় ঢাকার সুবিধা বেশি হওয়ার কারণে মানুষ গ্রাম থেকে ঢাকামুখী হবে, এটাই বাস্তবতা। তবে ঢাকা শহরের মানুষের সব ধরনের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য ড্যাপ বাস্তবায়নে যাতে কাজ করতে পারি, সেটাই আমার প্রত্যাশা।ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, উন্নত শহর গড়ার সব উপাদান নিয়ে ড্যাপ করা হয়েছে। তাই সবাই মিলে কাজ করলে ড্যাপ বাস্তবায়ন সম্ভব। এফবিসিসিআই অংশীজনদের নিয়ে ড্যাপ বাস্তবায়নে করণীয় নির্ধারণ করবে। বেসরকারিখাতকে সঙ্গে নিয়েই ড্যাপ বাস্তবায়নে সরকারকে এগুতে হবে। এবারের ড্যাপ যেন বাস্তবায়নযোগ্য হয়, এফবিসিসিআই সেই উদ্যোগ নেবে।বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) সভাপতি ও দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত এবারের ড্যাপ তৈরি করতে গিয়ে অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়েছে। আমি যত দূর শুনেছি, এবার সব খাতের মতামত নেওয়া হয়েছে। অথচ ২০১০ সালের ড্যাপ দেখে মনে হয়েছিল, বেসরকারিখাতকে একবারে নিশ্চিহ্ন করে করে দেওয়া হবে। তখন যিনি পূর্তমন্ত্রী ছিলেন, তার একটাই উদ্দেশ্যে ছিল—বেসরকারিখাত বলতে কোনো জিনিস থাকবে না। সবকিছু করবে সরকার। তখন সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন রিহ্যাবের সভাপতিসহ আমরা প্রতিবাদ করলাম। আমি প্রতিবাদ করলাম। আমার সঙ্গে বাদ-প্রতিবাদ অনেক কিছু হলো। পরে এ নিয়ে অনেক তর্কাতর্কি হলো।তিনি বলেন, তখনকার এক প্রখ্যাত প্রকৌশলী, বাংলাদেশের গর্ব ছিলেন, তিনি নিজেও স্বীকার করলেন ওই ড্যাপে ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। ড্যাপে অনেক ভুল-ত্রুটি হয়েছে। সেই ভুল ত্রুটি নিয়েই ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে হবে। গেজেট করতে হবে এবং সেটাই সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল একটাই—শুধু রাজউক, সরকারিখাতই ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বা আবাসন যাই বলেন, সবই করবে রাজউক ও সরকার।আহমেদ আকবর সোবহান আরও বলেন, তখন রিহ্যাবের এক সভায় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সেখানে সবাই বললেন—যে ড্যাপ হচ্ছে, তা তো দেশকে ধ্বংস করে দেবে। তখন প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন—আমি ড্যাপ রিভিউ কমিটি করে দিয়েছি। তখন তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী রিভিউ কমিটি গঠন করেছিলেন সাতজন মন্ত্রী, ২১ জন সচিবকে নিয়ে। সেই রিভিউ কমিটি ড্যাপ পর্যালোচনা করে, যারা শুদ্ধ তাদের নতুন করে অনুমোদন দেওয়ার কথা বললেন প্রধানমন্ত্রী। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় মনোবল না থাকলে আজকে আবাসন খাতের ঢাকার দুই হাজারসহ সারাদেশের ২০ হাজার ডেভেলপার নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, বহুল প্রতীক্ষিত ড্যাপ অবশেষে বাস্তবায়ন হচ্ছে। আমরা চাই না ড্যাপ আর দীর্ঘায়িত হোক। আমরা চাই ড্যাপ দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। এখন বাস্তবায়নটা কে করবে? রাজউক মূল বাস্তবায়নকারী হবে না সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন করবে সেটা নিয়ে আমাদের একমত হতে হবে। ঢাকা শহরে ২ কোটির বেশি মানুষের বসবাস। গত চার বছরে ৪ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষ গ্রাম থেকে শহরে মাইগ্রেট করেছে। শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের জন্য মানুষ ঢাকায় আসে। আমি মনে করি ড্যাপ বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশন একটা ভাইটাল রোল প্লে করবে। রাস্তা বানাবে সিটি করপোরেশন, ফুটপাত বানাবে সিটি করপোরেশন, জলাবদ্ধতা নিরসন করবে সিটি করপোরেশন। পৃথিবীর সব দেশেই সিটি করপোরেশন এসব কাজ করছে। সিটি করপোরেশন মানেই শুধু ময়লা ও ড্রেন পরিষ্কার করবে, তা নয়।পূর্ত সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার বলেন, ড্যাপে ছোটবড় সব বিষয়ে ডত ধরনের সমস্যা রয়েছে, তা বিবেচনা করা হয়েছে। এতে সব ধরনের প্রক্রিয়াও অনুসরণ করা হয়েছে। আজকের সেমিনারের পাওয়া মতমতও বিবেচনা করার হবে।নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, কয়দিন আগে প্রস্তাবিত ড্যাপের কপি পেয়েছি। ভালো করে দেখার সময়ও পাইনি। তবে এতটুকু বুঝেছি, এতে নানা ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। ড্যাপ কাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে? তাদের সেই সক্ষমতা আছে কি না, তাও বিবেচনায় নিতে হবে।নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ড্যাপ বাস্তবায়নে যেন বেশি সময় না নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিছু শর্তসাপেক্ষে এটি অনুমোদন দেওয়া সম্ভব। এর আগে ঢাকার স্ট্রাকচার প্ল্যান অনুমোদন দেওয়া দরকার।স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, মাত্র চারদিন আগে ৪ হাজার পৃষ্ঠার ডুকুমেন্ট দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই স্বল্পসময়ে সবকিছু পড়তে পারিনি। নতুন প্রস্তাবনায় আমাদের আগের দেওয়া সুপারিশ বা তথ্যগুলো খুঁজে পাইনি। রাজধানীতে কতগুলো ‘ছিটমহল’ রয়েছে। যেখানে সরকারের কোনো দফতর বা সংস্থা প্রবেশ করতে পারে না, কাজ করতে পারে না। গণতান্ত্রিক সরকারের সময় নগর সরকারের কোনো বিকল্প দেখি না। সরকারের একাধিক সংস্থা ঢাকা শহর নিয়ে কাজ করে কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই।রাজউক চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী  বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই ২০১০ সালের ২২ জুন প্রথম ঢাকা মহানগর অঞ্চলের জন্য গেজেটের মাধ্যমে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। যার মেয়াদ ছিল ২০১৫ সাল পর্যন্ত। এরপর ওই বছরের মার্চ থেকে শুরু হয় ড্যাপ ২০১৬-২০৩৫ প্রণয়নের কাজ। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার ১৫২৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে একটি আধুনিক, দৃষ্টিনন্দন ও বাসযোগ্য মহানগরী গড়ে তুলতে প্রস্তাবিত ড্যাপ প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। আজকের জাতীয় সেমিনারে স্টেকহোল্ডারদের মতামতের ভিত্তিতে এটি চূড়ান্ত রূপ পাবে।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

বড়াইগ্রামে নির্যাতিত আ’লীগ কর্মীর বাড়িতে বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী

বগুড়ার কনসার্টে যুবক খুন