জীবিকার যুদ্ধে সাপের খেলা

জীবিকার যুদ্ধে সাপের খেলা

শাহজাহান সুজন, রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) : বিজ্ঞান আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে পল্লী গ্রামের ঐতিহ্য সাপের খেলা। সাপুরেরা দল বেধে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়াত। কোন খোলা মাঠে তাবু খাটিয়ে রাত যাপন করত তারা। সকাল হতেই পোটলা-পুটলি নিয়ে বেরিয়ে পড়ত গ্রামে গ্রামে পাড়ায় পাড়ায়। সাপের খেলার সাথে সাথে বিভিন্ন রোগের ওষুধ, ঝাড়-ফুঁক করত তারা। হাটবাজারে অলিগলি কিংবা রেল ষ্টেশনের আশেপাশে মজমা বসাতো। ৯০ এর দশকেও এরকম দৃশ্য হরহামেশা চোখে পড়ত। হঠাৎ এই রকম দৃশ্য চোখে পড়ে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বাজারস্থ রেল লাইনের পাশে বিভিন্ন বয়সের মানুষ জড়ো হয়েছেন সাপ খেলা দেখতে। প্রসঙ্গক্রমে কথা হয় সাপুরের সরদার কানাই লাল-এর সাথে সুদূর পার্বতীপুর জেলা থেকে রাজারহাটে এসেছেন। তিনি বলেন, আগে সাপের খেলা, ঝাড়-ফুঁক, ওষুধ বিক্রি করে সংসার ভালোই চালাতাম। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের এই পেশা আর ঠিক মত চলছে না। মানুষ বিশ^াস করতে চায়না। অনেকেই অবহেলার চোখে দেখে। আয় রোজগার নাই বললেই চলে। এই দুর্মূল্যের বাজারে এই অবস্থায় পরিবার পরিজন নিয়ে চলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বেদে কথাটি বৈদ্য এর বিবর্তিত রূপ -বৈদ্য>বাইদিয়া>বাইদ্যা>বেদে। জেমস ওয়াইজের মতে, সংস্কৃত ব্যাধ থেকে বেদে শব্দটি এসেছে। আবার ভিন্ন মত ও আছে। বলা হয়ে থাকে, বেদুইন থেকে বেদে শব্দের উদ্ভব। জনশ্রুতি আছে, তাদের আদি নিবাস মিসরে। বেদুইন হিসেবে মিসর থেকেই তাদের প্রথম পথ চলা শুরু। খ্রিস্টীয় সাত শতকের শেষ দিকে তাদের পূর্বপুরুষরা আরব উপদ্বীপের আলবাদিয়া বন্দরে বসবাস করতো। অন্য এক তথ্যানুযায়ী, তারা পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার পা ুয়াতে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। তারা মাদ্রাজের অধিবাসী বলে একটি মতও রয়েছে। আবার কারো মতে, বেদেরা বাংলাদেশে এসেছে আরাকানের মনতং- মান্তা নৃগোত্র থেকে। ১৬০০ থেকে ১৬৫০ খিস্টাব্দের মাঝামাঝি কোনো এক সময় তারা বল্লাল রাজের সঙ্গে ঢাকার বিক্রমপুরে আসে। কেউ কেউ এও বলেন, তারা পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুরা জেলার বিষ্ণুপুরের মল রাজাদের উত্তরসূরি। বিষ্ণুপুরে সাপকে কেন্দ্র করে আজও ঝাঁপান উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। এ উৎসবে শরীরে সাপ পেছিয়ে নৃত্য করা হয়। প্রকৃত বাস্তবতা হলো এই যে, তাদের আদি শিকড় কোথায় প্রোথিত, তা আজও অনুদঘাটিত। বেদেরা নিজেদের মাঙতা বা মানতা নামে ডাকে। মাঙতা অর্থ মেগে বা ভিক্ষা করে খাওয়া। তারা সাপ, বাঁদর, ভালুক ইত্যাদি নাচিয়ে, শারীরিক কসরত- জাদুর খেলা দেখিয়ে, পোক-জোঁক ফেলে, শিঙ্গা বসিয়ে, শেকড়-বাকর ও তাবিজ-কবজ বিক্রি করে, তন্ত্র-মন্ত্র পড়ে- লোকজন থেকে যা পায় তা-ই দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে বলে তারা নিজেদের মানতা নামে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। তারা এক ধরনের পেশাজীবী গোষ্ঠী। শান্দার মানতা, মাল মানতা ও বাজিকর মানতা- এ তিন সম্প্রদায়ের মানুষ এ নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য বাংলাপিডিয়াদের ৯টি এবং জেমসওয়াইজ এদের ৭টি শ্রেণি পেশায় বিভক্ত করেছেন। যদিও এদের মাঝে কোনো জাতিভেদ প্রথা নেই। সাহসী এই নৃগোষ্ঠী এক সময় রাজা-বাদশাহ বা জমিদারদের পেশাদার গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করতেন। গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে এক ধরনের সাংকেতিক ভাষা আদান-প্রদান করতেন। পরবর্তীকালে এই ভাষাই মাঙতা- ঠেট- ঠের ভাষা হিসেবে নিজেদের ভাষার স্থান দখল করে, যা তাদের পেশাগত কাজের ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। আজো বাংলাদেশসহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের বেদে বা মনতা নৃগোষ্ঠী এই ভাষাতেই নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান করেন, কথা বলেন। এই ভাষাটি স¤পূর্ণ মৌখিক, এর কোনো লিখিত রূপ নেই।
বাংলাদেশের যশোহরের কালিয়াগঞ্জ, ঢাকার সাভার, বিক্রমপুর, খড়িয়া, গোয়ালিমান্দ্রা, কানসার গ্রাম, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া, ধামরাই, সুনামগঞ্জের ছাতক, সোনাপুর, মুন্সীগঞ্জের মুন্সির হাট, লৌহজংয়ের গোয়ালীমান্দা, মৌলভীবাজারের মনু নদীর পাড়, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর, চাঁদপুরের মতলব, বরগুনার বামনা, জামালপুরের কাচারীপাড়া, নাটোরের সিংড়াবাজার, শেরপুরের ঝিনাইগাতীর দুধনাইবাজার, মাদারীপুরের মাদারীপুর বাজার, গাজীপুরের জয়দেবপুর, কুমিলার হাজিগঞ্জ বাজার, চৌদ্দগ্রাম-চান্দিনা, ফেনীর সোনাগাজী, চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ফতেহাবাদ, মিরসরাই, রাউজানের মুন্সীরঘাটা এলাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৭ লাখ বেদে স্থলে ও নৌকার মাধ্যমে জলে বসবাস করে। তবে ঢাকার সাভারে একসঙ্গে অনেক বেদে বসবাস করে। সাভারের কাঞ্চনপুর, বক্তারপুর, খঞ্জনকাঠি, সচীনগর, পোড়াবাড়ি, ওমরপুর, ছোট ওমরপুরে একসঙ্গে প্রায় ২২ হাজার বেদে বসবাস করে।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

দুর্ঘটনার আশঙ্কায় জনমনে উদ্বগে বীরগঞ্জের সড়কগুলো দাপিয়ে বড়োচ্ছে কিশোর চালকরা

সন্দ্বীপে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা উদ্বোধন