নিজস্ব প্রতিবেদক : কবি শামসুর রাহমান ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ কবিতায় লিখেছেন-‘বুঝি তাই উনিশশো উনসত্তরেও/আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ/বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে/সালামের মুখ আজ উন্মথিত মেঘনা/সালামের চোখ আজ আলোকিত ঢাকা/সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা।’ এই কবিতার মধ্যে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনই যে স্বাধীনতার প্রেরণা, তা বুঝতে কারোরই সংশয় নেই।
পাকিস্তান আন্দোলন ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের সময় থেকে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় পর্যন্ত পূর্ব বাংলার জনসাধারণের মনে ভবিষ্যত স্বাধীন আবাসভূমিকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন জেগেছিল। এক শোষকের বদলে নতুন আর কোন শোষকে, এক অত্যাচারীর বদলে নতুন আরেক অত্যাচারীকে তারা ক্ষমতায় বসাচ্ছে- এ কথা তারা তখন ভাবতেও পারেনি। অন্যায়মুক্ত, অভাবমুক্ত, প্রেমপ্রাচুর্য ঐশ্বর্যপূর্ণ নতুন জীবনের স্বপ্নই তাদের একদা পাকিস্তান আন্দোলনে আকৃষ্ট করেছিল।
ব্রিটিশ সরকার বিদায় করে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদার প্রথার উচ্ছেদ ঘটিয়ে কৃষক জনতার জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করে নতুন দেশে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে সুখী-সুন্দর নতুন জীবন সৃষ্টি করার প্রতিশ্রুতি মুসলিম লীগের নাজিমউদ্দিন-আকরম খানবিরোধী অংশও মানুষের মনে নতুন আশা-আকাক্সক্ষা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে তখন বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। বলাবাহুল্য এ অঞ্চলে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনী প্রচার ও পরিচালনার নেতৃত্ব ছিল সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের হাতে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, নিখিল ভারত কিষাণসভা, শেরেবাংলা ফজলুল হক পরিচালিত কৃষক-প্রজা পার্টি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের আন্দোলনের ফলে কৃষিপ্রধান পূর্ব বাংলার কৃষক- জনতার মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিল। এ আন্দোলনের পরই চলে আসে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তর (১৯৪৩) যে অর্থনৈতিক দুর্দশার সৃষ্টি করেছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তা আরও তীব্রতা লাভ করতে থাকে। দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। পূর্ব বাংলায় ১৯৪৮, ১৯৪৯, ১৯৫০ এবং ১৯৫১ সালে দুর্ভিক্ষ, অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে বিলাসিতার জীবনযাপন। এ পরিস্থিতিতেই পূর্ব বাংলার হাজার কণ্ঠে সেøাগান উঠে ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়-লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’ এবং ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি সেøাগান উঠেছিল।
পাকিস্তান সৃষ্টির আগ থেকেই পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানের একটা প্রভাব চরম আকারেই ছিল। কারণ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে পূর্ব বাংলার মানুষও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছিল। অবশেষে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই পাকিস্তানীদের আসল চেহারা ফুটে উঠে। কৃষিপ্রধান পূর্ব বাংলার কৃষক জনতার জীবন ছিল বহু সমস্যায় আকীর্ণ। সেগুলোর প্রতি কোন দৃষ্টি ছিল না মুসলিম লীগ সরকারের। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানী শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ গড়ে উঠে এই বঙ্গে। অবশ্য এর আগে পাকিদের বিরুদ্ধে রাজশাহীর নাচোল বিদ্রোহ, ময়মনসিংহের টঙ্ক প্রথাবিরোধী বিদ্রোহ, সিলেটের নানকার প্রথাবিরোধী বিদ্রোহ হয়েছে।
পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কতগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন ঘটনা এ আন্দোলনের ঐতিহাসিক মূল্য এবং তাৎপর্যকে কখনই সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারে না। বস্তুতপক্ষে পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন তৎকালীন রাজনীতির সঙ্গে একই গ্রন্থিতে অবিচ্ছিন্নভাবে গ্রথিত এবং সেই অনুসারে পরস্পরের সঙ্গে নিবিড় ও গভীরভাবে একাত্ম। প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রাম হিসেবে ভাষা আন্দোলনের মুখ্যত দৃষ্টি পর্যন্ত ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ। এই দুই পর্যায়ের আন্দোলনের সচেতনতা, ব্যাপকতা, সাংগঠনিক তৎপরতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে তারতম্য এত বেশি যে, প্রথম দৃষ্টিতে তারতম্যকে মনে হয় গুণগত। ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের মধ্যকার এই তফাতকে বুঝতে হলে মধ্যবর্তী চার বছরের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতির খতিয়ান ব্যতীত তা কিছুতেই সম্ভব নয়। ১৯৪৮ সালের আন্দোলনের সঙ্গে ’৫২ সালের আন্দোলনের এই পার্থক্যকে বুঝতে এবং ব্যাখ্যা করতে হলে এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে পূর্ব বাংলার ব্যাপক জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে যা কিছু ঘটেছিল এবং তার ফলে যে পরিবর্তন সমগ্র পরিস্থিতির মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল, তা ভালভাবে জানা দরকার। পরিস্থিতির এই বিবরণের সঙ্গে পরিচিত হলে দেখা যাবে যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন মুষ্টিমেয় ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীর আন্দোলন নয়, তা শুধু শিক্ষাগত অথবা সাংস্কৃতিক আন্দোলনই ছিল না। বস্তুতপক্ষে তা ছিল পূর্ব বাংলার ওপর সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার পাকিস্তানী শাসক ও শোষক শ্রেণীর জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি বিরাট ও ব্যাপক গণআন্দোলন।