খাদ্যে ভেজালকারী নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার

খাদ্যে ভেজালকারী নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশে খাদ্য ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে মাঠে নামতে যাচ্ছে সরকার। যে কোনো মূল্যে সরকার নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। ওই লক্ষ্যে খাদ্যে ভেজাল, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্য বিক্রিতে জারি হচ্ছে কঠোর বিধিনিষেধ। পাশাপাশি খাদ্যপণ্য ব্যবসায়ীরা নানা বাধ্যবাধকতার আওতায় আনা হচ্ছে। সেজন্যই বিগত ২০১৩ সালে প্রণীত নিরাপদ খাদ্য আইনের কঠোর বাস্তবায়নে প্রণয়ন করা হয়েছে নিরাপদ খাদ্য প্রবিধিমালা। ওই প্রবিধিমালায় ব্যবসায়ীরা খাদ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যেসব কাজ করতে বাধ্য থাকবে তার বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। ওসব বিধিনিষেধ অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর লাইসেন্স বাতিল, জেল জরিমানাসহ একাধিক শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, উন্নত বিশ্বে খাদ্যে ভেজাল দেয়াকে মানুষ হত্যার কাছাকাছি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। সেজন্য শাস্তির বিধানও সেভাবে রাখা হয়েছে। ফলে কঠোর আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে ওসব দেশে কোন ব্যবসায়ী খাদ্যে ভেজাল দেয়ার কথা চিন্তাও করতে না। মূলত কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ এবং নজরদারির ফলে উন্নত বিশ্বে নিরাপদ খাদ্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, হোটেল রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে রাস্তার খাবার (স্ট্রিট ফুড) পর্যন্ত নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু এদেশে খাদ্যে-ভেজালের বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ প্রতিরোধ হয়েছে। দেশের সচেতন মানুষ বিভিন্ন সময় রাস্তায়ও নেমেছে। কিন্তু বাস্তবতা আশার আলো দেখায়নি। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকার আরো কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, দেশে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকার ২০১৩ সালে দেশের প্রচলিত আইনের সংস্কার করে কঠোর বিধিনিষেধসহ নতুন আইন প্রণয়ন করে। ওই আইনে লাইসেন্স বাতিলসহ সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছর জেল, ৩ লাখ টাকা জরিমানা, ক্ষেত্র বিশেষে দুই সাজাবা এক সঙ্গে দেয়া এবং মামলা করার বিধান রয়েছে। তবে আইনটি সংক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে নানা সীমাবদ্ধতা থেকে যায়। আইন প্রণয়ন ছাড়াও সরকারের একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। ওসব আদালতে প্রতিদিনই কারো না কারোর শাস্তি হচ্ছে। তারপরও শতভাগ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হয়নি। নানা সীমাবদ্ধতায় ওসব উদ্যোগও যথেষ্ট নয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার নিরাপদ খাদ্য বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। আশা করা হচ্ছে ওই বিধিমালা যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হলে মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হবে।
সূত্র আরো জানায়, প্রণয়নকৃত প্রবিধিমালায় বলা হয়েছে, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে খাদ্য ব্যবসায়ীদের খাদ্য প্রস্তুত বা প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে অনুমোদিত রাসায়নিক ব্যবহার করতে হবে। প্রিজারভেটিভ বা রঞ্জক বা ঘ্রাণ সৃষ্টিকারী রাসায়নিক বা ব্যবহৃত অন্য যে কোন রাসায়নিকের নাম, বৈজ্ঞানিক সংকেত, রাসায়নিক কোড, পরিমাণ, গ্রেড, বিশুদ্ধতা, উৎপাদনকারী ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম এবং ঠিকানা, উৎস স্থান বা দেশ, উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, খাদ্যে ব্যবহারের উপযুক্ততা ইত্যাদি তথ্য নথিভুক্ত করে প্রত্যেক ব্যাচভিত্তিক তথ্য ও প্রমাণক খাদ্য ব্যবসায়ীরা সংরক্ষণ করবে। উৎপাদন বা আমদানি করা খাদ্যে অনুমোদিত রাসায়নিক বা ভারি ধাতু বা তেজস্ক্রিয় পদার্থ বা রঞ্জক বা সুগন্ধি বা ক্ষতিকর অণুজীব ইত্যাদির উপস্থিতি বা মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি রয়েছে কিনা তা শনাক্তে স্বীকৃত পরীক্ষাগারে খাদ্যের নমুনা বিশ্লেষণ করে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সংরক্ষণ করতে হবে। তাছাড়া খাদ্যের মান নির্ধারিত পর্যায়ে রয়েছে কিনা, ব্যবসায়ীরা তা স্বীকৃত খাদ্য পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করাবে এবং সন্তোষজনক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে খাদ্য বা খাদ্যপণ্য বাজারজাত করবে। ব্যবসায়ীরা খাদ্যের মেয়াদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করবে এবং যার ভিত্তিতে খাদ্যের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে, সেই বিশ্লেষণ পপ্রতিবেদন বা তথ্যাদি ও প্রমাণক সংরক্ষণ করবে। তবে আমদানি করা খাদ্যপণ্যের মেয়াদ মূল প্রস্তুতকারী নির্ধারণ করবে।
সূত্র আরো জানায়, ব্যবসায়ীরা খাদ্য ব্যবসা পরিচালনা সংশ্লিষ্ট প্রমাণক ও দলিলাদি হালনাগাদ করবে এবং কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী পেশ করবে। কাঁচামাল চিহ্নিতকরণ, প্রক্রিয়াকরণ, উৎপাদন, আমদানি, সরবরাহ ও বিক্রয় কার্যক্রম যাচাইয়ের প্রয়োজনীয় প্রমাণক সংরক্ষণ করবে এবং অন্য কোন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে খাদ্য বা খাদ্য উপকরণ (কাঁচামাল), মৎস্যখাদ্য, পশুখাদ্য বা খাদ্য বা মৎস্য ও পশুখাদ্যের সংযোজক দ্রব্য ইত্যাদি সরবরাহ বা গ্রহণ করলে তা চিহ্নিত করার জন্য প্রমাণক সংরক্ষণ করবে। অন্য কোন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে খাদ্য বা খাদ্যপণ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে খাদ্য ব্যবসায়ীর নাম ও ঠিকানা; খাদ্যের যথাযথ বিবরণ; খাদ্যের পরিমাণ, লট, ব্যাচ, চালান (যা প্রযোজ্য) শনাক্ত করার স্মারক ইত্যাদি; প্রত্যেকটি লেনদেন বা সরবরাহের তারিখ; সংশ্লিষ্ট অন্যান্য তথ্য প্রমাণক হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে। খাদ্য প্রস্তুত বা প্রক্রিয়াকরণের পদ্ধতি পরিবর্তন বা কারিগরি বিচ্যুতি সংশোধন, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের নিয়ন্ত্রণ ধাপ সম্পর্কিত তথ্যাদি এবং খাদ্যদ্রব্যের বিশেষ সংরক্ষণ, সরবরাহ বা বিতরণ ও ব্যবহারের প্রমাণ সংরক্ষণ করতে হবে। ওসব প্রমাণ ও তথ্য খাদ্যপণ্যের মেয়াদ উত্তীর্ণের পর কমপক্ষে তিন মাস পর্যন্ত এবং খাদ্য ব্যবসার অন্যান্য তথ্য বা প্রমাণ ৫ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করবে।
এদিকে প্রবিধিমালায় আরো বলা হয়েছে, খাদ্য ব্যবসায়ীকে নিশ্চিত করতে হবে যে, খাদ্য ব্যবসায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং আইন ও বিধি-বিধান ও নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে থাকে। খাদ্য ব্যবসায়ীকে তার কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে প্রশিক্ষণের হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে। খাদ্য ব্যবসায়ীকে নিশ্চিত করতে হবে, খাদ্যদ্রব্য প্রস্তু ও স্থানান্তর বা পরিবহনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ রয়েছে এবং যে কাজে তারা নিয়োজিত ওই কাজে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ সম্পর্কিত জ্ঞান ও দক্ষতার প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকে। খাদ্যের বিশেষ সংরক্ষণ ব্যবস্থা (খাদ্য হিমায়িত, শীতলীকৃত, বায়ুনিরোধকৃত, নিয়ন্ত্রিত বা পরিবর্তিত গ্যাসীয় ইত্যাদি কারিগরি বা প্রযুক্তিগত পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে সংরক্ষণ) নিশ্চিত করতে হবে এবং ওই বিশেষ সংরক্ষিত খাদ্য সরবরাহ বা বিতরণ ও বিক্রির ক্ষেত্রে একই প্রকারের বা সমজাতীয় কারিগরি বা প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে। যদি কোন খাদ্য ব্যবসায়ী তার খাদ্য ব্যবস্থাপনায় বা খাদ্য ব্যবসায়ে পদ্ধতিগত বা প্রকৃতিগত বা প্রযুক্তিগত কোন সংস্কার বা পরিবর্তন সাধন করে বা করার উদ্যোগ নেয়, তাহলে ওই পরিবর্তনের বিষয়টি পরিদর্শনের জন্য কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনকালে পরিদর্শক বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে, খাদ্য ব্যবসায়ী বা তার কোন প্রতিনিধি, খাদ্যকর্মী বা কর্মচারী ওই প্রবিধিমালার প্রযোজ্য শর্ত পালন করছেন না, তাহলে ওই খাদ্য ব্যবসায়ীকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শর্ত পালনের জন্য নোটিস দেয়া হবে। তারপরও শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে খাদ্য ব্যবসায়ীকে সতর্ক করে নোটিস দেয়া হবে। তারপরও শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে তা নিরাপদ খাদ্যবিরোধী কাজ বলে গণ্য হবে। কোন খাদ্য ব্যবসায়ী নোটিসে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে করণীয় পদক্ষেপ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে পরিদর্শক বা কর্তৃপক্ষ তার খাদ্য ব্যবসা পরিচালনার লাইসেন্স বা নিবন্ধন সনদ বাতিল করার জন্য সংশ্লিষ্ট নিবন্ধক বা লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করবে। একই সঙ্গে বিষয়টি তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানাবে। ভোক্তাকে জানানোর উদ্দেশ্যে পরিদর্শকের দেয়া সব নোটিস খাদ্যপণ্যের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে প্রদর্শন করতে হবে। নিরাপদ খাদ্যপণ্য সরবরারে যে কোন অপরাধের জন্য লাইসেন্স বাতিল ছাড়াও জেল-জরিমানা এবং ক্ষেত্র বিশেষ উভয় দণ্ড এবং আইনের মুখোমুখি করা হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আব্দুল কাইউম জানান, ২০১৩ সালের আইনে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে ব্যবসায়ীরা কী করবেন তা বলা ছিল। সেটি ছিল সংক্ষিপ্ত আকারে। প্রবিধিমালায় বিস্তারিত দেয়া হয়েছে। সেগুলো মানতে তারা বাধ্য থাকবেন। না মানলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মূল আইনে শাস্তির বিষয়টি রয়েছে। আর প্রবিধিমালার কারণে তদারকি আরো সহজ হবে। আগে ব্যবসায়ীদের অজুহাত ছিল কিভাবে তারা নিরাপদ খাদ্যপণ্য নিশ্চিত করবে তা স্পষ্ট নয়। এখন তারা সেটা আর বলতে পারবে না। আমদানি ও বিক্রয় সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডসহ খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্রস্তুতকরণ, মোড়কজাতকরণ, পরিবহন, গুদামজাতকরণ, বিতরণ, প্রদর্শন ও বিপণনের সব পর্যায়ের জন্য ওই প্রবিধিমালায় বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। এখন আর তাদের জানতে, বুঝতে অসুবিধা হবে না। জেনে বুঝে কেউ আইন অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এখন আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়নে সকল বাধা দূর হবে এবং প্রবিধানের শর্ত পালন করতে ব্যর্থ হলে খাদ্য ব্যবসায়ীকে শাস্তির মুখে পড়তে হবে।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

১৬৯ কর্মচারিকে চাকরিচ্যুত করলো রাসিক

মেহেন্দিগঞ্জ পল্লী কর্মসংস্থান ও সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের কর্মসূচি-৩ পরকল্পের চেক বিতরণ