বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হচ্ছে না

বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হচ্ছে না

মোস্তাকিম ফারুকী : বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হচ্ছে না। বরং ধারাবাহিকভাবে তা কমছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২১ হাজার ২৩৯ মেগাওয়াট। কিন্তু বিশাল ওই সক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে। বিগত এক দশকে দেশে সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে বিদ্যুৎ খাত। এ সময়ে একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে বিদ্যুৎ খাতের স্থাপিত সক্ষমতা ২১ হাজার ২৩৯ মেগাওয়াট এবং প্রকৃত উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার ৭৪৮ মেগাওয়াট। কিন্তু ওই বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি খুব বেশি গতি পাচ্ছে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কয়েক বছর ধরেই বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন সক্ষমতার ব্যবহার কমছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে। যদিও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সক্ষমতার ৪৩ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৫ শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রায় ৪৮ শতাংশ ব্যবহার হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ৫ বছর ধরে যদি বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের উপরে না থাকে, তবে স্থাপিত সক্ষমতার ব্যবহার ৪০ শতাংশেরও নিচে নেমে যাবে। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত সক্ষমতার বিরূপ প্রভাব বিপিডিবির আর্থিক অবস্থা এবং বিদ্যুতের দামের ওপর পড়বে। নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়াও বেসরকারি ও সরকারি কোম্পানির কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ কেনার জন্য স্বল্প (রেন্টাল) ও দীর্ঘমেয়াদি (আইপিপি বা ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) বিপিডিবির চুক্তি থাকে। ওই কেন্দ্রগুলোতে ব্যবহৃত তেল, গ্যাস, কয়লা বা জ্বালানির মূল্য দেয় বিপিডিবি। বিদ্যুতের দাম থেকে শুরু করে সারা বছর কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি ইউনিট অর্থ বরাদ্দ থাকে। তাছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ভাড়া দেয়া হয়, যা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে পরিচিত। যখন কোনো কেন্দ্র থেকে সরকার বিদ্যুৎ নেয় না, তখন এনার্জি ও বিদ্যুতের দাম দেয়া বন্ধ থাকে। কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্র ভাড়া ও রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ ঠিকই পরিশোধ করতে হয়।
সূত্র জানায়, ১০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে বছরে প্রায় ৮০-৯০ কোটি টাকা শুধু কেন্দ্র ভাড়াই দিতে হয় । ফলে কেন্দ্র অলস বসে থাকলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সরকারের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। ফলে বিপিডিবির আর্থিক ক্ষতি পোষাতে সরকারকে বিপুল অংকের টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। পাশাপাশি ক্ষতি পোষাতে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোরও প্রয়োজন হয়। তাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র অব্যবহৃত থাকার বোঝা ভোক্তার ওপর গিয়ে পড়ে। আর নতুন আইনের মাধ্যমে এখন থেকে বছরে একাধিকবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। অতিরিক্ত সক্ষমতাই দেশের বিদ্যুৎ খাতে শেষ সমস্যা নয়। ভবিষ্যতে আমদানিকৃত ব্যয়বহুল কয়লা এবং এলএনজিও বিদ্যুতের ইফনিটপ্রতি দাম বাড়াবে। বেশি দামের কারণে ইতিমধ্যে গত বছর বাংলাদেশ এলএনজির একাধিক টেন্ডার বাতিল করেছে। ভবিষ্যতে এ উদ্বেগ আরো বাড়তে পারে। কেননা ২০২১ সালের শুরুতে এশিয়ান এলএনজির রেকর্ড দাম হয়েছে। ফলে সঠিক নীতির অভাবে সরকারের আর্থিক ভর্তুকি আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।
সূত্র আরো জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিপিডিবিকে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (৮৮০ মিলিয়ন ডলার) ভর্তুকি দিতে হয়েছে। উৎপাদন সক্ষমতার পরিপূর্ণ ব্যবহার না করার কারণে সরকারের অর্থের অপচয় ও ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) মনে করছে। সম্প্রতি প্রকাশিত আইইইএফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ৫ বছরে নতুন যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে, সেগুলো যোগ হলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে। ২০২৫ সাল নাগাদ আরো ২১ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হবে। ওই সময়ে মাত্র সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র অবসরে যাবে। কিন্তু বিদ্যুতের চাহিদা যদি বৃদ্ধি না পায় তাহলে সক্ষমতার ব্যবহার ৪০ শতাংশেরও নিচে নেমে যাবে। চলতি বছরের শেষে এক হাজার মেগাওয়াট নতুন, ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্রিডে সংযুক্ত হতে পারে, যা আমদানিকৃত কয়লা ও এলএনজির পাশাপাশি বিপিডিবির ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করবে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি ইমরান করিম জানান, দেশের বিদ্যুৎ খাতের সামগ্রিক যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তা ঠিক আছে। তবে সরকার যে উৎপাদন সক্ষমতার পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে সেটি আরো পরিষ্কার হওয়া দরকার। কেননা সক্ষমতার সঙ্গে চাহিদার যে প্রকৃত পরিসংখ্যান সেটি দেখাতে পারলে প্রকৃত হিসাবটা বোঝা যাবে। ২০২৫ সালের মধ্যে বড় যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসবে, তখন ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে হবে। ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্টে’র ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গেলে সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে না। ফলে বিদ্যুতে ভর্তুকিও কমে আসবে।
অন্যদিকে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) ন্যাশনাল সোলার এনার্জি অ্যাকশন প্ল্যান করেছে, সেটিকে যৌক্তিক বলে জানিয়েছে আইইইএফএ। গবেষণা সংস্থাটি বলছে, স্রেডার পরিকল্পনায় শুধু সৌরশক্তি থেকে ২০৪১ সাল নাগাদ ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তার মধ্যে ১২ হাজার মেগাওয়াট আসবে শুধু রুফটপ সোলার থেকে। ভিয়েতনাম গত বছরেই শুধু রুফটপ সোলার থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। সরকারের উচিত হবে স্রেডার এ পরিকল্পনা অধিকতর গুরুত্ব দেয়া। তাছাড়া বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন উন্নত করতে অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। তার ফলে যেমন উচ্চ সক্ষমতার নবায়নযোগ্য শক্তিনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্রিডে সংযুক্ত হতে পারবে। পাশাপাশি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতেরও সর্বোচ্চ ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন জানান, মোট উৎপাদন সক্ষমতার বিপরীতে যে চাহিদা তা কভিডের কারণে গত বছরে কম ছিল। নতুন বছরে শুরুতেই শীত মৌসুম হওয়ায় সেটি আরো কমেছে। তবে কিছুদিন পর তা আবার বাড়বে। ক্যাপাসিটি চার্জ কমিয়ে আনার জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র ব্যবহার করা হচ্ছে না। তাছাড়া যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা নেই সেসব কেন্দ্রের নতুন করে চুক্তি হবে কিনা তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

পবিপ্রবি র‌্যাগিংয়ে আহত পাঁচ শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তি

বড়াইগ্রামে নির্যাতিত আ’লীগ কর্মীর বাড়িতে বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী