একক প্রচেষ্টায় ২০০ প্রকারের ধান উদ্ভাবন করেছেন রাজশাহীর কৃষক

একক প্রচেষ্টায় ২০০ প্রকারের ধান উদ্ভাবন করেছেন রাজশাহীর কৃষক

আবুল কালাম আজাদ, রাজশাহী : একক প্রচেষ্টায় ২০০ প্রকারের ধান উদ্ভাবন করেছেন রাজশাহীর কৃষক নূর মোহাম্মদ। সংকরায়নের মাধ্যমে এসব ধান উদ্ভাবন করেছেন তিনি।
উদ্ভাবিত এসব ধানের মধ্যে পাঁচটি জাতের ধান ইতিমধ্যে কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। যা চাষাবাদ করে কৃষকরা ভালো ফলন পাচ্ছেন।
নূর মোহাম্মদ নিজেও তার জমিতে এসব উদ্ভাবিত ধান চাষাবাদ করেন। বরেন্দ্র অঞ্চলের খরা সহিষ্ণু ও রোগ বালাইমুক্ত এসব ধান জাতীয় বীজ প্রত্যয়ন বোর্ডের অনুমোদন পাওয়ার উপযোগী বলে মনে করেন নূরমোহাম্মদ। নূর মোহাম্মদ কৃষি পরিবেষা বা সংক্ষেপে এনএমকেপি-১০১, এনএমকেপি-১০২, ১০৩ এভাবে ধানগুলোর নামকরণ করেছেন। এবছর রোপা আমন মৌসুমে তিনি তার তিন বিঘা জমিতে খন্ড খন্ডভাবে ৭৪ প্রকারের ধানবীজ চাষাবাদ করেছিলেন। বোরো মৌসুমেও চাষাবাদ করার জন্য তিনি তার বীজতলা তৈরি করেছেন।
উদ্ভাবক কৃষক নূর মোহাম্মদের বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার গোল্লাপাড়া গ্রামে। কৃষক পরিবারের জন্ম নেওয়া নূর মোহাম্মদের পড়ালেখা বেশিদূর পর্যন্ত করতে পারেননি। ছোটবেলা থেকেই কৃষি পেশার সাথে সম্পৃক্ত তিনি।তবে কৃষকদের জন্য খরা সহিষ্ণু ও রোগ বালাইমুক্ত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবনের আগ্রহ ছিলো শুরু থেকেই।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও ধান গবেষণা ইন্সটিউটিউটের প্রশিক্ষণ তাকে এ কাজে উৎসাহিতকরে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা তেমন না থাকলেও শুধুমাত্র প্রশিক্ষণ ও বাস্তব জ্ঞানকে সম্বল করে তিনি তার গবেষণা শুরু করে দেন।
তিনি নিজের জমিতেই প্রতিবছর আমন, আউশ ও বোরো মৌসুমে বীজতলা তৈরি করে সংকরায়নের উদ্যোগ নেন তিনি। তারপর সংকরায়নের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি মেনে তার গবেষণা কাজ এগিয়ে নেন। যেখানে তত্ত্বীয়ভাবে গবেষণা করতে বৈজ্ঞানিকদের ১৪ থেকে ১৫ বছর সময় লাগে, সেখানে তিনি ৭ থেকে ৮ বছরে জাত তৈরি করেন।
নূর মোহাম্মদ প্রতিবছর বোরো, আমন ও আউশ মৌসুমের আগেই ঠিক করে নেন, এবছর কোন কোন প্রকার ধানের সংকরায়ন ঘটাবেন তারপর সেই অনুযায়ী বীজতলা তৈরি করেন। তারপর চারা রোপনের মাধ্যমে ধান চাষ করে সংকরায়নের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি মেনে নতুন সারি তৈরি করেন।এভাবে সব ধাপ মেনেই তিনি ২০০ প্রকারের ধান উদ্ভাবন করেছেন বলে দাবি তার। যার মধ্যে কমপক্ষে পাঁচটি জাতীয় বীজ প্রত্যয়ন বোর্ডের অনুমোদন পাওয়ার যোগ্য বলে মনে করেন তিনি। এ পাঁচটি জাত খরা সহিষ্ণু ও রোগবালাই মুক্ত। যা চাষাবাদ করতে কৃষকরা ভালো ফলন পেয়েছেন। কোনো কোনো সময় এ ফলন ধান গবেষণা ইন্সটিউটিউটের পরিচিত জাতের চেয়েও ভালো ফলন এসেছে।
নূর মোহাম্মদ জানান, আমি দীর্ঘ সময় ধরে সংকরায়ন ও বাছাইকরণের মাধ্যমে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমের ধানের অনেকগুলো সারি পেয়েছি।সারিগুলো স্বল্প মেয়াদী, উচ্চ ফলনশীল, সরু, সুগন্ধিযুক্ত ও খরা সহিষ্ণু। সারির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গাছগুলো মজবুত ও সহজে হেলে পড়েনা। কতগুলো সারি ধান পাকার পরও গাছ মজবুত থাকে। রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ অন্যান্য জাতের তুলনায় অনেক কম। খরা সহিষ্ণু সারিগুলো প্রজননকালে ১৫ থেকে ২০ দিন বৃষ্টি না হলেও খরা মোকাবেলা করে ভালো ফলন দিতে সক্ষম।খরাপীড়িত বরেন্দ্রভূমিতে কীভাবে, কম সময়ে ও কম পানি ব্যবহার করে ধান কেটে ঘরে তোলা যায় সেই গবেষণা কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই আমার এই গবেষণা চলমান রয়েছে।
তিনি আরো জানান, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় কৃষক তথা কৃষির উন্নয়নে সর্বোপরি দেশের খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে তার এ গবেষণা কার্যক্রম বিশেষ অবদান রাখবে বলে তিনি মনে করেন। কৃষির আধুনিক প্রযুক্তিগুলো গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়বে এটাই তার প্রত্যাশা।
নূর মোহাম্মদের উদ্ভাবিত ধান নিয়ে নিজ জমিতে চাষাবাদ করেছেন বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা কামাল উদ্দীন।নূর মোহাম্মদের কাছ থেকে পাঁচ কেজি বীজ নিয়ে তিনি কক্সবাজারেরউখিয়া উপজেলায় তার গ্রামের এক বিঘা জমিতে গতবছর বোরো মৌসুমে চাষাবাদ করেছিলেন। এক বিঘা জমিতে ফলন পেয়েছেন ৩২ মণ। তিনি বলেন, নূর মোহাম্মদের উদ্ভাবিত ধান লাল ও খয়েরি রঙের। গাছগুলো মজবুত বলেই মনে হয়েছে। ফলনও ভালো হয়। আবার খেতে সুগন্ধিযুক্ত ও সহজে হেলে পড়ে না।
তানোর উপজেলার গুবরীপাড়া গ্রামের কৃষক নওশাদ আলী জানান, গতবছর বোরো মৌসুমে নূর মোহাম্মদের প্লটে গিয়ে সেখানে লাল রঙের একটা ধান আমার খুব পছন্দ হয়। ধানটির নাম এনএমকেপি-১০৫। তখনই তাকে বলেছিলাম ধানটির বীজ দেওয়ার জন্য। এবছর তার কাছ থেকে পাঁচকেজি ধানের বীজ নিয়ে বীজতলা তৈরি করেছি। এক বিঘা জমিতে চাষাবাদ করবো।
একই উপজেলার ডুবইল গ্রামের কৃষক গোলাম মোস্তফা জানান, তার কাছ থেকে সোনালী রঙের ১০ কেজি ধানের বীজ নিয়ে রোপা আমন মৌসুমে চাষাবাদ করেছিলাম। ধানটি বোরো মৌসুমের হলেও রোপা আমন মৌসুমে এক বিঘা জমিতে চাষাবাদ করে ২০ মণ ফলন পেয়েছি। বোরো মৌসুমে তাহলে বেশি ফলন হওয়ার কথা। আবার ধান চিকন হওয়ায় খেতেও সুস্বাদু।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট রাজশাহী অঞ্চলের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. ফজলুল ইসলাম বলেন, ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে যেসব ধানকে অবমুক্ত করা হয়েছে সেসব ধান জাত হিসেবে পরিচিত। তার আগ পর্যন্ত ধানের সারি বা লাইন হিসেবে বলতে হবে। যেহেতু নূর মোহাম্মদের উদ্ভাবিত ধান এখনো সরকারিভাবে গৃহিত হয়নি তাই তার ধানকে এখনো জাত বলা যাবে না। তার উদ্ভাবিত তিনটি ধান নিয়ে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট পরীক্ষা করে দেখেছে।সেখানে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত সরকারিভাবেউদ্ভাবিত যেসব ধান স্বীকৃত পেয়েছে সেসব জাতের ফলনকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।জাত হিসেবে অনুমোদন পেতে হলে, বিশেষ বৈশিষ্ট্য যেমন থাকতে হবে, ঠিক একইভাবে ফলনও বেশি হতে হবে। কিন্তু নূর মোহাম্মদ উদ্ভাবিতধানের ফলন ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের উদ্ভাবিত ধানের ফলন ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। তাই তার ধান নিয়ে আর এগুনো সম্ভব হয়নি।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

দুর্ঘটনার আশঙ্কায় জনমনে উদ্বগে বীরগঞ্জের সড়কগুলো দাপিয়ে বড়োচ্ছে কিশোর চালকরা

সন্দ্বীপে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা উদ্বোধন