রাজধানীতেই ঘটছে অধিকাংশ অগ্নিকান্ডের ঘটনা, মানা হচ্ছে না নির্দেশনা

রাজধানীতেই ঘটছে অধিকাংশ অগ্নিকান্ডের ঘটনা, মানা হচ্ছে না নির্দেশনা

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানী ঢাকাতেই সবচেয়ে বেশি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। অগ্নিকান্ডের ঘটনা কমিয়ে আনতে ফায়ার সার্ভিস থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। বিদায়ী বছরে বহুল আলোচিত ছিল রাজধানী পুরান ঢাকার নিমতলী, চুড়িহাট্টা, বনানীর এফ আর টাওয়ারের মতো ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলো। ওসব অগ্নিকান্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে আগুনে পুড়ে মানুষজনের মর্মান্তিক মৃত্যু ও অগ্নিদগ্ধের ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলোয় থানায় মামলা হয়েছে। দায়িদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ এবং তদন্ত চলছে। পুলিশ ও দমকল বাহিনী সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সূত্র জানায়, রাজধানীতে গত বছরে শুধুমাত্র একই বস্তিসহ অন্তত অর্ধডজন বস্তিতে আগুন লেগেছে। তার মধ্যে মিরপুর ঝিলপাড় বস্তি, চলন্তিকা বস্তি, বনানীর টিএ্যান্ডটি বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। তাতে নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে গেছে হাজার হাজার বস্তিবাসী। নিম্নশ্রেণীর মানুষজন যাদের রাজধানীতে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তারা অশ্রু চোখে বিত্তবানদের করুণা আর সহায়তা কামনা করেছে। একের পর এক বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় সর্বস্ব পুড়ে ছাই হয়ে রাস্তায় ঠাঁই নিতে হয়েছে গৃহহীন হয়ে পড়া নিম্ন আয়ের মানুষজন। অগ্নিকান্ডের প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু কোনো তদন্ত প্রতিবেদনই আলোর মুখ দেখেনি। ফলে আড়ালেই থেকে যাচ্ছে অগ্নিকান্ডের সত্যি ঘটনা। উদঘাটিত হয়নি অগ্নিকান্ডের কারণ।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ২০১০ থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ১০ বছরের পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী সর্বোচ্চ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়। তাছাড়া সারাদেশে ছোটবড় ১৬ হাজার অগ্নিদুর্ঘটনায় ১ হাজার ৬১০ জন মারা গেছে। আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। শুধু গত বছরই রাজধানীসহ সারাদেশে অন্তত ৩২টি বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। ওসব আগুনে শিশু-নারীসহ মারা গেছেন অন্তত ২০ জন। বিদায়ী ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যেই দেশব্যাপী অগ্নিকান্ডের ঘটনা সর্বনাশা রূপে আর্বিভূত হয়ে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষকে রিক্ত, নিঃস্ব করে দিয়েছে। সারাদেশে বিদায়ী বছরে ছোট বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে ১৮ হাজার ১০৪টি। তাতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৩শ’ ৪১ কোটি টাকা। রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ অগ্নিকান্ডের ঘটনার জন্য মানুষজনের অসচেতনতা, ঘনবসতি, অপরিকল্পিত নগরায়ন ইত্যাদিকে দায়ী করা হয়েছে। আর অগ্নিকান্ডের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে গ্যাসের চুলা, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, পূর্ব শত্রুতায় আগুন লাগিয়ে দেয়া, খামখেয়ালির ঘটনা। বিদায়ী বছরে বহুল আলোচিত ছিল রাজধানী ঢাকায় সোনার খনির মতো মূল্যবান জমিতে গড়ে উঠা অবৈধভাবে বস্তিগুলোর অগ্নিকান্ডের ঘটনা।
সূত্র আরো জানায়, বিদায়ী বছরের শুরুতেই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল। গত বছরের ২ জানুয়ারি ঢাকা আইনজীবী সমিতি ভবনে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল। তারপর ৫ জানুয়ারি সাভারের আশুলিয়া বাজারের আজিজ সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। তারপর ৯ জানুয়ারি ঢাকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার স্টলে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। আর মিরপুরে চলন্তিকা বস্তির আগুনে পারভিন (৩৫) নামে এক নারীর অগ্নিকান্ডে দগ্ধ হয়ে মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বনানীর টিএ্যান্ডটি কলোনি বস্তির অগ্নিকান্ডের ভয়াবহতায় অন্তত দমকল বাহিনীর ২২ ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে অংশগ্রহণ করে। তারপর ২৭ ফেব্রুয়ারিতে নিউ ইস্কাটনের দিলু রোডের একটি পাঁচতলা ভবনের গ্যারেজে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় শিশুসহ ৩ জন নিহত হয়। তাছাড়াও রাজধানী ঢাকার সোয়ারি ঘাট, মহাখালীর সাততলা বস্তিসহ বিভিন্ন অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অনেক মানুষজন রিক্ত নিঃস্ব হয়ে সর্বস্ব হারা হয়ে পথে বসে গেছে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলদারিত্ব, আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, বস্তির ভাড়া আদায়সহ নানা কারণে বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেয়াটাও স্বাভাবিক। আগুনে পুড়ে গত কয়েক বছরে পুড়েছে অনেকের ঘর, নিভেছে অনেক জীবন। বস্তিতে নিয়মিত বিরতিতে এভাবে অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলা হয় না। হতাহত হলেই কেবল মামলা হয়, তাও অপমৃত্যুর। তারপর আবার তদন্ত হয় না। এখন পর্যন্ত যতো অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে, তাতে দফায় দফায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। ভারি হয়েছে সুপারিশের তালিকা। কিন্তু দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ওসব সুপারিশ কাগজপত্রেই রয়ে গেছে। গত পাঁচ বছরে দেশের বস্তিগুলোয় সহস্রাধিকের বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও একটিরও অভিযোগপত্র দাখিল করেনি পুলিশ। স্বাভাবিকভাবেই ওসব অগ্নিকান্ডে কাউকে দায়িও করা যায়নি।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, পুরান ঢাকার নিমতলীর অগ্নিকান্ডের পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে ১৭ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। তাছাড়া পুরান ঢাকার অগ্নিকান্ডের চুড়িহাট্টার ঘটনায় ৩১ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। বনানীর এফ আর টাওয়ারের পরপরই দেখা গেল অনেক দৌড়ঝাঁপ। আইনের অভাব নেই, কিন্তু আইনের ব্যবহার দেখা যায়নি। অগ্নিকান্ডের কারণ কমিয়ে আনার বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তার কোন বাস্তবায়ন করা যায়নি। বিদায়ী বছরে যেসব কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে এবং অগ্নিকাণ্ড কমিয়ে আনার বিষয়ে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে নতুন বছরে অগ্নিকাণ্ড কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

১৬৯ কর্মচারিকে চাকরিচ্যুত করলো রাসিক

মেহেন্দিগঞ্জ পল্লী কর্মসংস্থান ও সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের কর্মসূচি-৩ পরকল্পের চেক বিতরণ