নিজস্ব প্রতিবেদক : যাত্রী চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ রেলওয়ে এক্সপ্রেস, মেইল ও লোকাল ট্রেনের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। বরং দেশে সাধারণ মানুষের সামর্থ্যরে মধ্যে থাকা ট্রেনগুলো একে একে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। রেলওয়ে প্রায় চার যুগ ধরে দ্বিতীয় শ্রেণীর কোনো কোচ আমদানি করেনি। ফলে দেশের প্রান্তিক মানুষ অতিরিক্ত ভাড়ায় আন্তঃনগর ট্রেনে ভ্রমণ করতে বাধ্য হচ্ছে। আর স্বল্প দূরত্ব ও উৎপাদিত পণ্য পরিবহনের জন্য নিয়োজিত বেশ কয়েকটি লোকাল ট্রেনের কোচ সংখ্যা কমিয়ে ট্রেনগুলোকে বন্ধের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামসহ সিলেট, ঢাকার বেশ কয়েকটি লোকাল ট্রেন দিয়ে সাধারণ মানুষ প্রতিদিন কৃষিজ পণ্য নিয়ে শহরে চলাচল করতো। কিন্তু কোচ কমে যাওয়া ও ট্রেন সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কৃষকরা পণ্য নিয়ে শহরে আসতে পারছে না। যা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্বল্প দূরত্বের যাত্রীদের জন্য ভোগান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েতে সর্বশেষ দ্বিতীয় শ্রেণীর কোচ সংযোজন হয়। তারপর আশির দশকে আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস চালু হওয়ার পর রেলওয়ে মেইল-লোকাল-এক্সপ্রেস ট্রেনের জন্য কোনো কোচ আমদানি করেনি। অথচ বছর বছর আন্তঃনগর ট্রেনের কোচ আমদানি হলেও দ্বিতীয় শ্রেণীর কোচ আমদানি না হওয়ায় স্বল্প দূরত্ব ও কম দামে রেল সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নিম্নবিত্ত মানুষ। রেলওয়ের পরিবহন বিভাগের তথ্যানুযায়ী চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ-বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব রুটের ময়মনসিংহ এক্সপ্রেস (৩৭/৩৮), ঢাকা-নোয়াখালী-ঢাকা রুটের ঢাকা এক্সপ্রেস ও নোয়াখালী এক্সপ্রেস (১১ ও ১২ নং ট্রেন), ঢাকা-সিলেট-ঢাকা রুটের সুরমা এক্সপ্রেস (৯ ও ১০ নং ট্রেন), ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ বাজার-ঢাকা রুটের ভাওয়াল এক্সপ্রেস (১৭/১৮) লোকাল ট্রেনগুলোতে পর্যাপ্ত যাত্রীর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু ওসব ট্রেন স্ট্যান্ডার্ড কম্পোজিশনের অর্ধেকেরও কম কোচ নিয়ে চলাচল করছে। তাছাড়া রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে মেইল, এক্সপ্রেস ও কমিউটার ট্রেনের সংখ্যা ৩৯ জোড়া। ওসব ট্রেনের জন্য মোট প্রায় ৬শ কোচের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর ওসব ট্রেন বর্তমানে চাহিদার তুলনায় ৫৬টি কোচ কম নিয়ে চলাচল করছে। করোনাকালে চট্টগ্রাম-সিলেট রুটের (১৩/১৪ নং ট্রেন) জালালাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। জুলাইয়ে কয়েকদিন চলার পর ইঞ্জিনস্বল্পতার অজুহাত দেখিয়ে চাহিদাসম্পন্ন এক্সপ্রেস ট্রেনটি আর চলাচল করেনি। একই অজুহাতে সিলেট-আখাউড়া রুটের কুশিয়ারা (১৭/১৮) ট্রেনটির চলাচলও বন্ধ করে দেয় রেলওয়ে। তাছাড়া চলাচলরত অন্য দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেনগুলোও স্ট্যান্ডার্ড কম্পোজিশনের প্রায় অর্ধেক কোচ নিয়ে চলাচল করায় স্বল্প দূরত্বের সাধারণ মানুষ ট্রেন সেবা পেতে ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পরপর রেলওয়ে রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর কোচ আমদানি করেছিল। পরবর্তী সময়ে আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস চালু হওয়ার পর রেলওয়ে ইরান, চীন, ইন্দোনেশিয়া ও ইন্ডিয়া থেকে কোচ আমদানি শুরু করে। প্রায় ৪০-৫০ বছর আগে আমদানি করা দ্বিতীয় শ্রেণীর কোচগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও এখনো রেলওয়েকে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। অথচ মাত্র দেড় বছর আগে আমদানি করা ইন্দোনেশীয় কোচগুলোর ত্রুটি আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। তারপরও রেলওয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর কোচ আমদানি না করে আন্তঃনগর ট্রেনের কোচ আমদানি ও আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস বাড়ানোর দিকেই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকছে রেলওয়ে। রেলের পরিবহন বিভাগের সাম্প্রতিক সময়ে উপবন, জয়ন্তিকা ও বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে অবমুক্ত হওয়া ৪৫টি কোচ নিয়েও বড় কোনো পরিকল্পনা নেই। তাছাড়া প্রতিটি ট্রেনের জন্য স্পেয়ার হিসেবে ২৫ শতাংশ কোচ মজুদ রাখা হয়। ওসব স্পেয়ার কোচ দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেনে সংযোজনের সুযোগ থাকলেও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। রেলওয়ের ওয়ার্কিং টাইম টেবিল-৫২-এ দেখা যায়, গড়ে ৬ থেকে ১২ কোচ নিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেন পরিচালনার ঘোষণা থাকলেও গড়ে দুই-তিনটি কোচ দিয়েও দ্বিতীয় শ্রেণীর বিভিন্ন ট্রেন চলাচল করছে।
সূত্র আরো জানায়, রেলওয়ে দেশব্যাপী আন্তঃনগর ট্রেনে সার্ভিস বাড়িয়েছে। বিদ্যমান ট্রেনগুলোর কোচ বৃদ্ধি ছাড়াও পুরনো কোচ বাদ দিয়ে আমদানিকৃত নতুন কোচের সমন্বয়ে বেশি দূরত্বের যাত্রীদের জন্য বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন রুট এক বছরের ব্যবধানে ৫টি নতুন আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস চালু করেছে। কিন্তু প্রায় ৩শ’টি মিটার গেজ কোচ আমদানি সত্ত্বেও রেলওয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেনের জন্য অবমুক্তকৃত কোচগুলো সংযোজনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। রেলের পরিবহন বিভাগের কোনো কোচ পরিকল্পনা না থাকায় আন্তঃনগর ট্রেনের অবমুক্ত হওয়া কোচগুলোও দেশের বিভিন্ন সেকশনে অলস পড়ে রয়েছে। তাছাড়া রেলের সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি হওয়া আন্তঃনগর ট্রেনের কোচের রেক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি হওয়া ৩শ কোচ সংযোজন ছাড়াও নতুন ট্রেন সার্ভিস চালু করা হয়েছে। গত এক বছরে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, বনলতা এক্সপ্রেস, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, বেনাপোল এক্সপ্রেস এবং জামালপুর এক্সপ্রেস নামের ৫টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। আর পারাবত এক্সপ্রেস, মহানগর এক্সপ্রেস, রংপুর এক্সপ্রেস, লালমণি এক্সপ্রেস, কালনী এক্সপ্রেস, তিস্তা এক্সপ্রেস, পাহাড়িকা ও উদয়ন এক্সপ্রেস, সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে নতুন করে কোচ ও ভালো মানের অবমুক্ত করা কোচ লাগানো হয়েছে। তবে অবমুক্ত হয়ে অলস বসে থাকা কোচগুলো দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেনে সংযোজনের কোনো উদ্যোগই নেই। অথচ রেলের কোচ সংকট মোকাবেলায় বিভিন্ন সময়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর কোচকেও মেরামত করে আন্তঃনগর ট্রেনে সংযোজন করা হয়েছে। তবে দেশের রেলসেবাকে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে দ্বিতীয় শ্রেণীর কোচ আমদানি ছাড়া উপায় নেই বলে রেলের প্রকৌশল বিভাগ সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
এদিকে এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক সরদার সাহাদাত আলী জানান, দীর্ঘদিন ধরে রেলের কোচ ও ইঞ্জিন আমদানি বন্ধ ছিল। বর্তমান সরকার রেলের উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ ছাড়াও রেল সেবার মান বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশকিছু আন্তঃনগর কোচ আসায় নতুন সার্ভিস ছাড়াও আন্তঃনগর ট্রেনের বিভিন্ন জরাজীর্ণ রেক প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। তবে দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেনের কোচ বাড়ানো বা নতুন কোচ সংযোজনের বিষয়ে এ মুহূর্তে কোনো পরিকল্পনা নেই।