নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে নকল খাদ্যপণ্য। আর অতি লাভের আশায় দোকানিকরাও ওসব পণ্য বিক্রিতে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাপক হারে নকল খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতের কারণে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। আর অর্থনীতিকে ফেলছে হুমকির মুখে। দেশের অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে নকল খাদ্যপণ্য উৎপাদন বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর হস্তক্ষেপ এবং অপরাধীদের শাস্তি বাড়ানো ও নিশ্চিত করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। বিএসটিআই এবং নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের খাদ্যপণ্য বেশি নকল হচ্ছে। আর নকল পণ্যের দাম ব্র্যান্ডের পণ্যের চেয়ে দামে অনেক কম বলে দোকানিরা না বুঝেই বেশি লাভের আশায় তা অবাধে বিক্রি করছে। দেশি কোম্পানির সরিষার তেল, বাঘাবাড়ি ব্র্যান্ডের ঘি, ভারতের নামিদামি ডাবর ব্র্যান্ডের মধু, মামা ব্র্যান্ডের ওয়েফার, বিস্কুট, বেভারেজ, সফট ড্রিংকস পাউডার, ডেইরি মিল্কসহ নানা ব্র্যান্ডের চকলেট, আচার, চিপস, চাটনি, আইসক্রিমসহ জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের বিভিন্ন প্যাকেটজাত নকল খাদ্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে। এ ধরনের পণ্যে শিশুদের আকর্ষণ বেশি। নিম্নমানের এ পণ্য কিনে খাওয়ায় শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ২০০৫ সাল থেকে ইতালিভিত্তিক বেসরকারি মালিকানার বহুজাতিক কনফেকশনারি ও গাম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান পারফেট্টি ভ্যান মেলে গ্রুপ তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। ওই কোম্পানির সেন্টার ফ্রুট, সেন্টার ফ্রেশ, অ্যালপেনলিবে ও মেনটস বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়। কিন্তু এদেশে ওসব পণ্য নকল হচ্ছে। কোম্পানির নাম ও ব্র্যান্ড সবকিছু ঠিক রেখে বাজারে ছাড়া হচ্ছে নকল পণ্য। যা দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই, তবে মুখে দিলে ভিন্ন স্বাদ পাওয়া যায়। রাজধানীর চকবাজারে কম দামে সেগুলো প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। শুধু চকবাজার নয়, প্রতারক চক্রের এজেন্টরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার দোকানে ওসব পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে। তাছাড়া নেসলের ম্যাগি নুডলস ও প্রাণের মিস্টার নুডলস নকল হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, রাজধানীতে নকল খাদ্যপণ্য তৈরির কারখানা সবচেয়ে বেশি পুরান ঢাকার বংশাল, লালবাগ, ইসলামপুর, চকবাজার, কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ ও বছিলা এলাকায়। বিভিন্ন সংস্থার ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানেও তার প্রমাণ মিলেছে। আর অভিযানে ধরা পড়লেও জরিমানা দিয়ে অনেকেই আবার একই কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের জুলাইতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় প্রাইম ন্যাচারাল ফুড প্রডাক্টসের বিভিন্ন পরিচিত ব্র্যান্ডের নকল আইস ললি ও ফ্রুট ড্রিংকস তৈরির খবর পেয়ে বিএসটিআই ও র্যাবের যৌথ অভিযানে অবৈধভাবে পণ্য উৎপাদনের প্রমাণ পায়। ওই অপরাধে প্রতিষ্ঠানটিকে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে মুন চকলেট অ্যান্ড ফুড প্রডাক্টস নামের কোম্পানিতে নকল চকলেট ও ক্যান্ডি তৈরির প্রমাণ পায় বিএসটিআই। গত সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকার আশুলিয়ায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ বেভারেজ উৎপাদনের প্রমাণ পায় বিএসটিআই। অনুমোদনহীন ওই পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে সিলগালা ও জরিমানা এবং মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পাশাপাশি ৮০ হাজার বোতল বেভারেজ জব্দ করে ধ্বংস করা হয়। গত অক্টোবরে মোহাম্মদপুর চাঁদ উদ্যানে খাস ফুড প্রডাক্টস নামে একটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে রাইস ব্রান তেল, মধু, সরিষার তেল, হলুদ, মরিচ, ধনিয়া গুঁড়া, চাটনি, দই, আটা, ঘি, আচারসহ বিভিন্ন নকল ও মানহীন পণ্য উৎপাদনের প্রমাণ পায় বিএসটিআই। পাশাপশি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানেও নকল খাদ্যপণ্য ধরা পড়ছে।
এদিকে নকল খাদ্যপণ্য প্রসঙ্গে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মঞ্জুর মোর্শেদ আহমেদ জানান, নকল ও ভেজাল খাদ্য বন্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। তবে প্রতিরোধে ভোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। ভোক্তারা অভিযোগ করলে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার আরো সুযোগ তৈরি হবে। জনগণ সচেতন না হলে নকল পণ্য বন্ধ করা কঠিন। সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠলেই এ কাজ ত্বরান্বিত হবে। নকল পণ্য জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে। এই উপলব্ধি থেকে জনগণের মানসিকতার পরিবর্তন হলে নকল পণ্য প্রতিরোধ করা যাবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বিএসটিআই’র উপ-পরিচালক রিয়াজুল হক জানান, মান সংস্থার অনুমতি ছাড়া অনেকেই নিম্নমানের ও নকল খাদ্যপণ্য তৈরি করছে। নিয়মিত অভিযানে তা ধরাও পড়ছে। খাদ্যপণ্যে নকল ও ভেজাল রোধে বিভিন্ন সমিতির সঙ্গে বৈঠক করে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি অবৈধ ওসব ব্যবসা বন্ধে বিএসটিআইর ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলছে। একই সাথে নিয়মিত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাও হচ্ছে।