পর্যটকদের আতঙ্ক সুন্দরবনের নদীর ডুবোচর

পর্যটকদের আতঙ্ক সুন্দরবনের নদীর ডুবোচর

নিজস্ব প্রতিবেদক ; খুলনা থেকে রাস উৎসবের উদ্দেশে তাপস পাল ১০ জন যাত্রী নিয়ে ট্রলার যোগে ছুটছেন। ২৮ নভেম্বর রাত দেড়টায় সুন্দরবনের ভ্রমরখালী বন টহল ফাঁড়ি থেকে যাওয়ার পথে বিধিবাম।
পথে ভাটার সময় মজ্জত নদীর শেষ ও বঙ্গোপসাগরের শুরুর (জিপিআরএস অনুযায়ী দুবলার চরের আলোর কোলের আওটার) মোহনায় বিশাল ডুবোচরে আটকে গেলো ট্রলার। এমন সময় শুরু হলো একের পর এক তুফান। উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ এসে আছরে পড়ছে ট্রলারের ভেতরেও। যাত্রীদের মধ্যে তৈরি হয় আতঙ্ক। ট্রলারচালক ও তার সহযোগীদের অবিরাম চেষ্টার পরও ট্রলার জায়গা থেকে নড়লো না। চালকের এক সহযোগী বললেন, প্রবল তুফানে মাঝেমধ্যে ট্রলারে ফাটল ধরে। এ কথা শোনার পর যাত্রীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ৯৯৯ এ কল দেন। ওই নম্বরে কল দেওয়ার পর সেখান থেকে কোস্টগার্ডের এক কর্মকর্তার নম্বর দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি সাহস নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বলেন। এভাবে প্রায় ৭ ঘণ্টা আতঙ্কের মধ্যে কেটে যায়। পরের দিন ২৯ নভেম্বর ভোর হলে দেখা যায় প্রায় ৩-৪ কিলোমিটার দীর্ঘ চরটিতে আরো পুণ্যার্থীবাহী প্রায় ৩০-৪০টি ট্রলার ও লঞ্চ আটকে আছে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে জোয়ারের পানি বাড়লে আবার শুরু হয় যাত্রা।
নুরু ইসলাম নামের এক যাত্রীর অভিযোগ, ৯৯৯ থেকে যারা কল রিসিভ করেছিলেন তারা একাধিকবার খবর নিলেও কোস্টগার্ডের লোকজন উদ্ধারে তো আসেননি কোনো খবরও নেননি।তাপস পাল জানান, তিনি দীর্ঘ বছর ধরে এই পথে চলাচল করেন। কিন্তু এখানে ডুবোচর আছে তা তার জানা ছিলো না। বেশ কয়েকজন নৌ-যান চালক জানান, সুন্দরবনের নদ-নদীতে দিন দিন ডুবোচর বাড়ছে। ভাটার সময়ে প্রায়ই ঠেকে যাচ্ছে নৌ-যানের তলা। কোনো ভাটার সময়ে ডুবোচরে নৌ-যান আটকে গেলে পরবর্তী জোয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এ সময় ট্যুরিস্টদের মধ্যে তৈরি হয় আতঙ্ক। তাদের সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। তারা জানান, নাব্যতা সঙ্কট ও ঘন কুয়াশায় প্রতিনিয়তই ব্যাহত হচ্ছে নৌ চলাচল। ভোগান্তিতে পড়ছে যাত্রীসাধারণ ও সংশ্লিষ্টরা। ডুবোচরে কোনো সংকেত দেওয়া থাকলে তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হতো না। নদীতে যদি সঠিকভাবে ড্রেজিং কাজ পরিচালনা করা হতো তাহলে আর ডুবোচরে আটকে থাকতে হতো না। অপেক্ষা করতে হতো না জোয়ারের জন্য।
জানা যায়, সুন্দরবন অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য নদ-নদীগুলো হচ্ছে- বলেশ্বর, পশুর, শিবসা, খোলপেটুয়া, কালিন্দি, মজ্জত, সুমতি, ছাপড়াখালি, বড়শেওলা, হারণচীনা, শাকবাড়ে সিঙ্গা, হংসবাগ, দোবেকি, ধানিবুনে, হরিখালি, পাট কোস্টা, বাসে, লাঠিকারা, ব্যয়না, কাসিটানা, দায়াহলড়ি, আড়ভাঙ্গা, ইলিশমারী, জলকি, বিবির মাদে, টেমখানি, চামটা, মধুখালি, পরশকাঠি, ধনপতি, রাগাখালি, কানাইকাঠি, মরিচঝাপি, নেতাই, শাকভাতে, চুনকুড়ি, মারাদি, যুগলবাড়ি, বাদামতলী, ঘাট হারানো, বড়বাড়ে, মুকুলে, বড় মাতলা, তুকুনী, কাঁচি কাটা, পারশেমারী ইত্যাদি। এসব নদীগুলোতে বর্ষাকালে পর্যাপ্ত নাব্যতা থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে পলি জমে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় এর পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পায়। আবার অনেক নদ-নদীতে ডুবোচর তৈরি হওয়ায় পর্যটকরা সুন্দরবন ভ্রমণে আতঙ্কে থাকেন। নদ-নদী বেষ্টিত দ্বীপভূমি সুন্দরবনের নৈসর্গিক সৈন্দর্য উপভোগ করতে আসা পর্যটকরা যেমন ভোগান্তিতে পড়েন তেমনি মোংলা বন্দরে আসা ছোট-বড় জাহাজ কার্গোও মাঝেমধ্যে সমস্যায় পড়ে ডুবোচরের কারণে। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী (নৌ) মো. নাছির উদ্দিন বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন হিরণ পয়েন্ট থেকে সুন্দরী কোঠায় নদ-নদীতে পলির প্রভাবে নাব্যতা সঙ্কট দেখা দেয়ায় আউটারবার প্রকল্পের আওতায় মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ ড্রেজিং কাজ সম্পন্ন করে ইতোমধ্যে চ্যানেলের নাব্যতা বাড়ানো হয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে মোংলা বন্দরে অধিক ড্রাফটের বাণিজ্যিক জাহাজ আগমন শুরু হয়েছে। এছাড়া ইনারবার প্রকল্পের আওতায় হাড়বাড়িয়া থেকে মোংলা বন্দর জেটি পর্যন্ত ১০ মিটার ড্রাফটের বাণিজ্যিক জাহাজ আগমনের লক্ষ্য নিয়ে ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে যা সম্পন্ন হলে মোংলা বন্দর জেটিতে নিরাপদে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রেজাউল করীম বলেন, পলি ও বালি জমে সুন্দরবন অঞ্চলের বেশ কিছু নদ-নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ডুবো চর। নাব্যতা সংকটের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সুন্দরবনের নদ-নদীতে বঙ্গোপসাগর থেকে জোয়ারে প্রচণ্ড পলি ও বালি আসে। যে কারণে ডুবোচর তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে বের করতে হবে কিভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে এ সমস্যার সমাধান করা যায়।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

১৬৯ কর্মচারিকে চাকরিচ্যুত করলো রাসিক

মেহেন্দিগঞ্জ পল্লী কর্মসংস্থান ও সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের কর্মসূচি-৩ পরকল্পের চেক বিতরণ