নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশীয় কাগজকলগুলো হঠাৎ করেই বই ছাপার কাগজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। মূলত বই ছাপার কাগজের চাহিদার কারণেই কাগজকলগুলো এমন সুযোগ নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে একদিকে ২০২১ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ৩৬ কোটি পাঠ্যবই ছাপার কাজ চলছে। অন্যদিকে চলছে একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে সৃজনশীল বই ছাপার কাজও। এমন অবস্থায় হঠাৎ করে বই ছাপার কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় মুদ্রণ শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছে। তাদের অভিযোগ, যৌক্তিক কারণ ছাড়াই এবার বই ছাপার কাগজের দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ বর্তমানে বাজারে লেখার কাগজের দাম না বেড়ে বরং কমেছে। মুদ্রণ শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বই ছাপার কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপার জন্য অনেক প্রিন্টিং প্রেসই কাগজ কিনতে পারছে না। এর বিপরীতে কাগজকলগুলো কাগজের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে পাল্পের (কাগজ তৈরির কাঁচামাল) মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ি করছে। যদিও বাজারে এখন পাল্পের কাছাকাছি দামেই লেখার কাগজ বিক্রি হচ্ছে। কিন্তুকাগজকলগুলো বই ছাপার কাগজের দাম প্রতি টনে ১০ হাজার টাকা বেশি নিচ্ছে। অথচ সচরাচর লেখার ও বই ছাপার কাগজ প্রায় কাছাকাছি দামেই বিক্রি হয়। বাজারে এ, বি ও সি- এ তিন ক্যাটাগরির লেখার কাগজ বিক্রি হয়। ওসব কাগজ এখন মিল থেকে প্রতি টন ৪৮ থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অনেক মিল কাগজ বিক্রি না করতে পারায় উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। এমন অবস্থায় বই ছাপার কাগজের চাহিদা তৈরি হয়েছে। আর ওই সুযোগে কাগজকলগুলো বই ছাপার কাগজ প্রতি টন ৫৮ থেকে ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। ফলে বাজারে তার বাড়তি দাম দাঁড়াচ্ছে প্রতি টন ৬২ থেকে ৬৫ হাজার টাকা। এই দাম বৃদ্ধিতে ক্ষতির শিকার হচ্ছে কাগজ-সংশ্নিষ্ট শিল্প। বর্তমানে শতাধিক দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান (প্রিন্টিং প্রেস) দেশজুড়ে ৩৬ কোটি পাঠ্যবই ছাপার কাজ করছে।
সূত্র জানায়, মুদ্রণ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো কাগজের দাম কম থাকার সময় তখনকার হিসাব অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের দরপত্রে অংশ নিয়ে কার্যাদেশ নিয়েছিল। এখন কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই তারা বই ছাপার কাজ বন্ধ রাখছে। কারণ চড়া দামে কাগজ কিনে বিনামূল্যে বিতরণের বই ছেপে যথাসময়ে সরবরাহ করা প্রিন্টিং প্রেসগুলোর পক্ষে দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন বছরের শুরুর দিনেই বিনামূল্যের পাঠ্যবই সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়ার উদ্যোগও ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতি, কাগজ আমদানিকারক সমিতি ও পেপার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী দেশে কাগজের চাহিদা রয়েছে বছরে ৮ লাখ টন। আর ওই চাহিদার বড় অংশই দেশে উৎপাদিত কাগজ দিয়ে মেটানো হয়। সরকারের বিনামূল্যে বিতরণের জন্য বই ছাপার কাজে বছরে প্রায় ৮০ হাজার টন পেপার প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ১২ হাজার টন পেপার কিনে দেয়। ওই কাগজ কয়েক বছর ধরে দেশের মিলগুলো থেকেই কেনা হচ্ছে। আগে দেশি কাগজের পাশাপাশি আমদানি কাগজে চাহিদা মেটানো হতো। এখন শুধু আর্টপেপারসহ বিশেষ ধরনের কাগজ আমদানি হয়। দেশের ৪০ থেকে ৪৫টি মিলে বেশি পরিমাণে চাহিদা থাকা কাগজ উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু সরকারি বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা শুরুর পর থেকেই মিলগুলো প্রতিনিয়ত কাগজের দাম বাড়াচ্ছে। মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে যৌক্তিক দামে কাগজ বিক্রি এবং সরবরাহ আদেশ নেয়া দরে দ্রুত কাগজ দেয়ার জন্য পেপার মিল অ্যাসোসিয়েশন ও বিভিন্ন মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু পেপার মিল অ্যাসোসিয়েশন থেকে সে ব্যাপারে আশ্বাস দিলেও মিলগুলো তা মানছে না। বরং ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে কাগজের দাম। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) নির্দিষ্ট পরিমাণ কাগজ আমদানির সুযোগ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। কারণ কাগজের দামের অবস্থা এমন হলে এবার পাঠ্যপুস্তক ছাপায় সংকট দেখা দিতে পারে। মূলত সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতেই কাগজের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।
এদিকে পেপার মিল সংশ্লিষ্টদের মতে, কাগজ মিলগুলো এখন লেখার কাগজ বিক্রি করতে পারছে না। বাজারে লেখার কাগজ এখন মিল থেকে ৫০ হাজার টাকা টনে বিক্রি করা হচ্ছে। কাঁচামালের দামেই কাগজ ছেড়ে দিতে হচ্ছে। বাজারে চাহিদা না থাকায় অনেক পেপার মিলে উৎপাদনই এখন প্রায় বন্ধের পথে। পাশাপাশি মিলগুলোতে কাগজের মজুদ বাড়ছে। করোনা পরিস্থিতিতে গত সাত-আট মাসের মধ্যে গড়ে এক মাসও মিল চালু রাখা সম্ভব হয়নি। লেখার কাগজের মূল্যের এই পরিস্থিতির মধ্যে মিলগুলো মুদ্রণশিল্পের কাগজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু কাগজ ব্যবসায়ীদের মতে, কাগজের বাজারে যে মন্দা চলছে, তাতে দাম বাড়ার কথা নয়। দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে যৌক্তিক দামে মিলগুলোর কাগজ বিক্রি করা উচিত।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত জানান, গত জুনে যখন পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের দরপত্রে অংশ নেয়া হয়েছিল তখনকার তুলনায় এখন কাগজের দাম প্রতি টনে ৫ হাজার টাকা বেড়েছে। তাই চুক্তি থাকলেও কাগজ মিল মালিকরা এখন আগের দামে কাগজ দিচ্ছে না। আবার ব্যবসায়ীদের পক্ষেও চড়া মূল্যে কাগজ কিনে পাঠ্যবই ছাপানো সম্ভব হচ্ছে না।
এ সম্পর্কে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান (এনসিটিবি) অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা জানান, মুদ্রাকররা জানিয়েছেন পেপার মিলগুলোর সঙ্গে তাদের চুক্তিতে বই ছাপানোর কাগজ কেনার জন্য যে মূল্য নির্ধারিত ছিল, মিলগুলো এখন ওই দামে কাগজ সরবরাহ করছে না। তারা বাড়তি দাম চাইছে। মুদ্রাকররা কাগজের মূল্য বাড়ার কথা জানানোর পর এনসিটিবির পক্ষ থেকে পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিসহ অন্যদের সঙ্গে কথা হয়েছে। দেশীয় পেপার মিলগুলোকে বলা হয়েছে মুদ্রাকর কাগজ ক্রেতাদের সঙ্গে বসে সমঝোতা করতে। নইলে বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহের মতো একটি জনহিতকর কাজ ব্যাহত হবে। তাছাড়া মুদ্রাকররা এনসিটিবির কাছে বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির সুযোগ চেয়েছে। এনসিটিবি পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনকে বলেছে, তারা সমঝোতা করতে ব্যর্থ হলে বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির সুযোগ দিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে সুপারিশ করা হবে।