নিজস্ব প্রতিবেদক ; বাংলাদেশের নন্দিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের চলে গেলেন না ফেরার দেশে। গতকাল শুক্রবার ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই বরেণ্য অভিনেতা। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৭৬ বছর। দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে ভুগছিলেন আলী যাকের। একইসাথে তিনি কোভিড-১৯ পজিটিভ ছিলেন। ১৯৪৪ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামে আলী যাকেরের জন্ম। ১৯৭২ সালের আরণ্যক নাট্যদলের ‘কবর’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে আলী যাকের নাট্যাঙ্গনে প্রবেশ করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সাল থেকে কাজ করছেন নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় নিয়ে। টেলিভিশন নাটক এবং মঞ্চনাটকে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন আলী যাকের। ১৯৮০ এবং ৯০’র দশকে আলী যাকের অভিনীত বেশ কিছু নাটক দর্শকদের মনে স্থান করে নিয়েছিল। তার অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বহুব্রীহি’ এবং ‘আজ রবিবারৎ। এছাড়া ‘নদীর নাম মধুমতি’ এবং ‘লালসালু’ সিনেমায় আলী যাকেরের অভিনয় দর্শকদের নজর কেড়েছিল। স্ত্রী সারা যাকেরকে নিয়ে গড়ে তোলেন দেশের বৃহৎ বিজ্ঞাপনী সংস্থা। শিল্পকলায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পেছনে আলী যাকেরের অবদান রয়েছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি।
গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নিয়ে আসা হয় এর ট্রাস্টি আলী যাকেরের মরদেহ। ঘণ্টাব্যাপী শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার বন্ধু-সুহৃদ-স্বজন এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা। করোনার মাঝেও প্রিয় অভিনেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে মানুষজন এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। তাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় শেষ বিদায়ে সিক্ত হন বরেণ্য নাট্যজন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের। শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানের শুরুতেই ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষে থেকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক আলী যাকেরকে। এরপর তাঁর মরদেহে একে একে শ্রদ্ধা জানান সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, নাট্যজন মামুনুর রশীদ, সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী, মফিদুল হক প্রমুখ। আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে আলী যাকেরের মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। আলী যাকেরের পরিবারের পক্ষে তাঁর মরদেহের পাশে উপস্থিত ছিলেন তার স্ত্রী নাট্যজন সারা যাকের, ছেলে ইরেশ যাকের ও মেয়ে শ্রিয়া সর্বজয়া। পরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থেকে আলী যাকেরের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বনানীতে তার প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিকের কার্যালয়ে। সেখান থেকে বাদ আসর আলী যাকেরের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বনানী কবরস্থানে। সেখানে জানাজা শেষে চিরনিদ্রায় শায়িত হন দেশের নাট্যাঙ্গনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব আলী যাকের।
রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর শোক: বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকেরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শুক্রবার এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, বরেণ্য অভিনেতা আলী যাকের ছিলেন দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার মৃত্যুতে দেশ একজন বরেণ্য অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে হারালো। তার মৃত্যু দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতি। রাষ্ট্রপতি মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
অন্যদিকে গতকাল শুক্রবার পৃথক এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশের শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আলী যাকেরের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এছাড়া শোকবার্তায় মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান প্রধানমন্ত্রী।
মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের শোক: আলী যাকেরের মৃত্যুতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমেদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরির্তন মন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। এ ছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম শোক প্রকাশ করেছেন। পৃথক শোকবার্তায় তারা বলেন, বরেণ্য অভিনেতা আলী যাকের ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছিলেন একাধারে অভিনেতা, পরিচালক, নির্দেশক, কলামিস্ট, নাট্য সংগঠক ও স্বনামধন্য বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্ণধার। টেলিভিশন ও মঞ্চ নাটকে সমান জনপ্রিয়। বিভিন্ন টিভি নাটকে তার অভিনয়ের মুন্সিয়ানা দর্শকের হৃদয় ছুঁয়েছে। এ শক্তিমান অভিনেতার মৃত্যুতে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে ক্ষতি হলো তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তিনি তার অভিনয় ও সৃজনশীল কর্মের মধ্য দিয়ে দেশের অগণিত দর্শকের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।
বিরোধীদলের শোক: এই নাট্যব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। গতকাল শুক্রবার এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, দেশের গুণী ও বর্ষীয়ান অভিনেতা আলী যাকের মুক্তিযুদ্ধের পরে আরণ্যক নাট্যদলে যোগদানের মাধ্যমে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হন। মঞ্চের পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকে অভিনয়কারী জনপ্রিয় এ অভিনেতা সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতেন। দেশের শিল্প ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে আমৃত্যু একনিষ্ঠ অবদান রেখেছেন তিনি। আলী যাকেরের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপি।