নিজস্ব প্রতিবেদক ; আগামী বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা পেছাতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পর তিন মাস সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পাঠদান শেষ করে এ দুই পাবলিক পরীক্ষা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। গতকাল বুধবার দুপুরে মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তি সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলতে আয়োজিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমরা আগামী বছরের এসএসসি ও এইচএসসি সঠিক সময়ে পরীক্ষা নিতে চাই। যেহেতু করোনা পরিস্থিতির কারণে গত এক বছর শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে গেছে, এজন্য তিন মাসের একটি সংক্ষিপ্ত সিলেবাস করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হলে এ সংক্ষিপ্ত সিলেবাস শেষ করে পরীক্ষা নেয়া হবে। তবে নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা হচ্ছে না। দুই-এক মাস হয়তো পেছাবে। এর মধ্যে তিন মাসে যতটুকু পড়ানো হবে ততটুকু নিয়েই পরীক্ষা নেয়া হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে সপ্তাহে ছয় দিন তাদের ক্লাস করানো হবে বলেও জানান তিনি।
এসএসসির ৭৫ ও জেএসসির ২৫ শতাংশ নিয়ে এইচএসসির ফল
শিক্ষামন্ত্রী জানান, এইচএসসির ফল নিয়ে বিশেষজ্ঞরা তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। এসএসসি ও জেএসসির রেজাল্ট নিয়েই এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হবে। তবে এসএসসির ফল ৭৫ শতাংশ এবং জেএসসির ২৫ শতাংশ গুরুত্ব দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ করা হবে। বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে মতামত দিয়েছেন। এর আলোকেই আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এইচএসসির ফলাফল প্রকাশ করা হবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করে সব পরীক্ষার্থীকে পাস ঘোষণা করা হয়েছে। এসএসসি-সমমান এবং জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার ফলের মাধ্যমে গ্রেড নির্ধারণ করা হবে। এজন্য আমরা একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করি। তারা বিভিন্ন বিষয় পর্যবেক্ষণ করে আমাদের কাছে একটি গ্রেড নির্ণয়ের জন্য একটি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এর আলোকে এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হবে। তিনি বলেন, গ্রেড নির্ণয়ের জন্য এসএসসি পরীক্ষার ফলকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। এ পরীক্ষার ফলের মোট নম্বরের ওপর ৭৫ শতাংশ এবং জেএসসি ২৫ শতাংশ নম্বর যুক্ত করে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হবে। যারা ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল তাদের ফলাফল কিভাবে দেয়া হবে- সে বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, তাদেরও প্রত্যাশিত নম্বর কম দেয়া হবে না। আগের পরীক্ষার ফলের ওপর মূল্যায়ন করে নম্বর দেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, বাউবিসহ যারা জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি তাদের তো আমরা গ্রহণ করেছি। তাদের এসএসসি পরীক্ষার ফলের ওপর ভিত্তি করে এইচএসসি পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হবে। পূর্বের পরীক্ষার সম বিষয়ের নম্বরকে গুরুত্ব দেয়া হবে। যেসব বিষয় মিল থাকবে না তা কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে সে বিষয়ে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। ডিসেম্বরের শেষ দিকে এ পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হবে বলে জানান তিনি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে প্রতিদিন ক্লাসে আসতে হবে না শিক্ষার্থীদের
করোনাভাইরাসের প্রকোপ না কমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হবে না। সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে বলেই মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মানা কঠিন হয়ে যাবে। এজন্য করোনার মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হবে না বলেও জানান শিক্ষামন্ত্রী। তবে করোনার প্রকোপ কিছুটা কমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে। তবে এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে বড় পরিবর্তন আসবে। আগের মতো প্রতিদিন ক্লাসে আসতে হবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রেণি ক্লাসের পাঠদান পরিচালনা করতে হবে বলে জানান ডা. দীপু মনি। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আগামী ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ছুটি আরও বাড়ানো হতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে। তবে আগের মতো শিক্ষার্থীদের পাঠদান দেয়া হবে না। সপ্তাহে ৬ দিন ক্লাস না নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সপ্তাহে ৩-৪ দিন ক্লাসে আসতে হবে শিক্ষার্থীদের। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আগামী বছরের এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের সপ্তাহে ৬ দিন ক্লাস করানো হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা নেয়া না হলেও তাদের শিক্ষা বোর্ড থেকে পাসের সনদ দেয়া হবে। সেই সনদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হবে। নিজ নিজ স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা পাসের সনদ পাবে। সেটি নিয়ে তারা নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবে।
গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার আহ্বান
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা না হলে ভর্তিচ্ছুদের বিশাল ভোগান্তি পোহাতে হয়। অনেকে মসজিদে রাত কাটান। আবার ছাত্রীদের সেই সুযোগও নেই। এর সঙ্গে আর্থিক ক্ষতি তো রয়েছেই। আর করোনার কারণে এটা সম্ভবই না। সে কারণে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় এ প্রক্রিয়ায় আসছে না, তাদেরকে আবারও বিষয়টি ভেবে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। দীপু মনি বলেন, যারা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় আসছে না, এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমরা কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। তবে তারা জনগণের স্বার্থবিরোধী কিছু করবে না বলে আশা করি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিতে পারে। মেডিকেলে আমরা সারাদেশে একসঙ্গে ভর্তি করতে পারছি। তাহলে একটি করে পরীক্ষা নিয়ে কেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি করতে পারব না? এরপরও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি এককভাবে চলতে চান, তাহলে বিষয়টি তাদেরকে ভেবে দেখতে হবে। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্ত্বশাসন দিয়েছিলেন। এ ছাড়া আইনের মধ্যে থাকুক বা না থাকুক, কারোর ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। আশা করি, সবাই গুচ্ছ পরীক্ষায় অংশ নেবেন, কেউ এর বাইরে থাকবে না। সব বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়েই এবার গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা হবে বলেও এ সময় আশা প্রকাশ করেন মন্ত্রী।
লটারিতে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি
সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লটারির মাধ্যমে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। এ বছর ক্যাচমেন্ট এরিয়া (বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা) ৪০ শতাংশের পরিবর্তে ৫০ শতাংশ করা হবে। ক্লাস্টারভিত্তিক ভর্তির ক্ষেত্রে লটারিতে পাঁচটি স্কুল নির্বাচন করতে পারবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষার মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে লটারিতে ভর্তি এবং দ্বিতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণির ক্ষেত্রে পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়ে থাকে। করোনা পরিস্থিতির কারণে ২০২১ শিক্ষাবর্ষে সকলস্তরে লটারির মাধ্যমে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে ঢাকা মহানগরীর আগের ৪০ শতাংশ ক্যাচমেন্ট এরিয়া পরিবর্তন করে ৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। আগে ক্লাস্টারভিত্তিক একটি স্কুলে আবেদন করার সুযোগ থাকলেও সেটি পাঁচটি করে পছন্দের স্কুল নির্বাচন করা যাবে। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, এ বছর স্কুল ভর্তির জন্য তিনটি বিকল্প পদ্ধতি চিন্তা করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথমটি আগের মত শিক্ষার্থীদের স্কুলে এনে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া বা এমসিকিউ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করা। দ্বিতীয়টি অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করা এবং তৃতীয়টি ভর্তি বাতিল করে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে স্কুলে এনে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করা সম্ভব নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষার জন্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করা কঠিন বলে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে লটারির মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে বিস্তারিত জানিয়ে দেয়া হবে। ইতোমধ্যে ভর্তির সময় চলে এসেছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশেষজ্ঞ, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে তিনটি বিকল্প থেকে একটি বেছে নেয়া হয়েছে। এদিকে, লটারির মাধ্যমে স্কুলে ভর্তি হলে মেধাবীদের পিছিয়ে পড়ার সুযোগ নেই। কোমলমতি শিশুদের মেধা নিরুপণ করা অযৌক্তিক। ভালো স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে ভাগ্যের ওপর কিছুটা নির্ভর করতে হবে। বর্তমান মহামারি পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ঝুঁকিতে না ফেলতে লটারির মাধ্যমে স্কুলে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। লটারির মাধ্যমে ভর্তি হলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভালো স্কুলে ভর্তি থেকে বঞ্চিত হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রত্যাশিত স্কুলে ভর্তি হতে না পেরে কেউ কেউ রাগান্বিত হবেন। এ ক্ষেত্রে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করতে হবে। তবে গুটিকয়েক স্কুলে ভর্তি হলেই মেধাবীদের সফলতা নির্ভর করে না। কীভাবে পড়ানো হচ্ছে সেটাই বিবেচ্য বিষয়। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ২০২২ সাল থেকে পাঠদান কার্যক্রম এবং কারিকুলামে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। তাই শুধু কয়েকটি সুনামধারী স্কুলে ভর্তি হতে পারলেই যোগ্যস্থান হয়েছে বলে মনে করা যাবে না। নামি স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য এক ধরনের উন্মাদনা তৈরি হয়েছে। এ থেকে বের হতে হবে। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একটি সাম্যের মধ্যে নিয়ে আসতে আমরা কার্যক্রম শুরু করছি। শিক্ষার্থী শুধু বই থেকেই নয়, পারিপার্শ্বিক থেকেও শিখবে। আর এই বয়সের শিক্ষার্থীদের মেধাবী হিসেবে গণ্য করা ঠিক না। এ সময় শিক্ষা উপমন্ত্রী মুহিবুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ১১-১২ বছরের শিশুদের মেধা নিরুপণ করা যায় না। ১৬ বছরের পরে এটা করা হয়। এর আগে তা করা হলে তা যৌক্তিক ও অনৈতিক। উন্নত দেশগুলোতেও এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। উপমন্ত্রী আরও বলেন, তাই কেউ যদি গুটিকয়েক স্কুলে ভর্তি হতে না পারলে মেধাবীরা বঞ্চিত হয়েছে বলে, তা ঠিক না। এটা বলা হলে তাদেরকে আবারও পরীক্ষা ও বইয়ের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে। আমাদের এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহাবুব হোসেন, কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক গোলাম ফারুক, বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন।