নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশজুড়ে লক্ষাধিক ফার্মেসি লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সে অবাধে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে বিপুলসংখ্যক ফার্মেসিই ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রিতে জড়িত। সারাদেশেই অলিগলিতে গড়ে উঠেছে নতুন অসংখ্য ওষুধের দোকান। আর সেগুলোর অধিকাংশই অবৈধ। রাজধানীসহ সারা দেশের জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ওসব দোকান বিস্তৃত। করোনাকালে নানা ধরনের স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জাম এবং বিভিন্ন ওষুধের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়য় ওসব ওষুধের দোকানের ব্যবসাও জমজমাট। নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, ওষুধ কোম্পানিগুলোর অতি ব্যবসায়িক মনোভাব এবং জনসাধারণের অসচেতনতার কারণেই অবৈধ দোকানগুলো ব্যবসা করার সুযোগ পাচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সারা দেশে প্রায় দেড় লাখ ওষুধের দোকানের নিবন্ধন নেই। তার মধ্যে প্রায় ৫০ হাজারই খুবই নিম্নমানের দোকান ওষুধের দোকান ব্যবসা করছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত ওষুধের দোকানের সংখ্যা এক লাখ ৫১ হাজার। তার মধ্যে গত দুই বছরে নতুন নিবন্ধন পেয়েছে ৩২ হাজার ৫৩৫টি। এই সময়ে অধিদফতর আরো ৪৩৬টি মডেল ফার্মেসির অনুমোদন দেয়। তবে নিবন্ধন ছাড়া দেশে কতগুলো ওষুধের দোকান রয়েছে তার সঠিক কোনো হিসাব ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের কাছে নেই। করোনার সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব ওষুধের দোকান গড়ে উঠেছে সেগুলোর বেশির ভাগেরই লাইসেন্স নেই। এমনকি ঔষধ প্রশাসনের নিয়মনীতি না মেনে ‘বি’ বা ‘সি’ গ্রেডের ফার্মাসিস্ট ছাড়াই ওসব দোকান চলছে। যদিও ইতিপূর্বে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, দেশে লাইসেন্সবিহীন কোনো দোকান থাকবে না।
সূত্র জানায়, খুচরা বা পাইকারি দোকানের ড্রাগ লাইসেন্স নেয়ার পর প্রতি ২ বছর অন্তর নবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নবায়ন না হলে বিলম্ব ফি দিয়ে নবায়নের সুযোগ আছে। কিন্তু অনেক ফার্মেসি মালিকই বছরের পর বছর পার হলেও লাইসেন্স নবায়ন করছে না। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকলেও ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর মেয়াদোত্তীর্ণ ওসব লাইসেন্স বাতিলে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। খুচরা ওষুধ বিক্রির জন্য অধিদফতর দুই ক্যাটাগরির লাইসেন্স দেয়। একটি হল মডেল ফার্মেসির, আরেকটি মেডিসিন শপের। মডেল ফার্মেসির জন্য প্রয়োজন হয় ৩০০ ফুটের একটি দোকান, পৌরসভার ভেতরে হলে ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং বাইরে হলে ১ হাজার ৫০০ টাকা। সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, যা ব্যাংকে জমা দিতে হয়। তাছাড়া ট্রেড লাইসেন্সের সত্যায়িত ফটোকপি, মালিকের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, মালিকের ব্যাংক সচ্ছলতার সনদ, ফার্মেসিতে নিয়োজিত গ্র্যাজুয়েট বা এ গ্রেড ফার্মাসিস্টের রেজিস্ট্রেশন সনদের সত্যায়িত ফটোকপি, ফার্মাসিস্টের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, ফার্মাসিস্টের অঙ্গীকারনামা, দোকান ভাড়ার চুক্তিনামা। তাছাড়া মেডিসিন শপের ক্ষেত্রে ১২০ ফুটের দোকান, ফার্মেসিতে নিয়োজিত বি বা সি গ্রেডের ফার্মাসিস্টের রেজিস্ট্রেশন সনদের সত্যায়িত কপি এবং মডেল ফার্মেসির মতোই অন্য সব সনদ দিয়ে শর্ত পূরণ করলেই ড্রাগ লাইসেন্স দেয়া হয়।
সূত্র আরো জানায়, নিয়ম অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার এক থেকে তিন মাসের মধ্যে ২০০ টাকা ফি দিয়ে পৌর এলাকার পাইকারি, ১০০ টাকা দিয়ে খুচরা দোকান ও ৫০ টাকায় পৌর এলাকার বাইরের দোকানের লাইসেন্স নবায়ন করা যায়। মেয়াদোত্তীর্ণের ৩ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত পৌর এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা ৫০০, খুচরা ব্যবসায়ীরা ২০০ আর পৌর এলাকার বাইরের দোকান ১০০ টাকা ফি দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করতে পারে। তাছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণের ১২ মাসের ঊর্ধ্বে বা পরবর্তী বছরের জন্য পাইকারি দোকান ১ হাজার ও খুচরা দোকানের ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা ফি দিয়ে লাইসেন্স নবায়নের সুযোগ রয়েছে। এতো সুযোগের পরও সারা দেশে প্রায় অর্ধেক ওষুধের দোকানেরই লাইসেন্স নেই। কেউ কেউ একেবারেই নিবন্ধন নেয়নি। আবার কেউ নিলেও পরে তা নবায়ন করেনি।
এদিকে লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সে ওষুধের ব্যবসার ব্যাপারে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি সংশ্লিষ্টদের মতে, সারা দেশে লাইসেন্সধারী ফার্মেসির সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। আর লাইসেন্স ছাড়া ওষুধের দোকান রয়েছে আরো প্রায় দেড় লাখ। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর ও বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির দুর্বলতার কারণে বহু ফার্মেসি লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া দেশে অবৈধভাবে পরিচালিত প্রায় ৫০ হাজার দোকান রয়েছে, যেগুলো একেবারেই মানসম্পন্ন নয়। সেগুলো বন্ধ করা জরুরি। তবে যেগুলো মানসম্পন্ন তাদের দ্রুত লাইসেন্সের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে শর্ত শিথিল করা যেতে পারে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা জানান, নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষদিকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের নির্দেশে দেশের সব জেলার ড্রাগ সুপার, সিভিল সার্জন, উপজেলায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের নিজ নিজ এলাকার ওষুধের দোকানের তথ্য জানাতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কতটি ফার্মেসি আছে, কতগুলোর লাইসেন্স আছে আর কতগুলোর লাইসেন্স নেই ইত্যাদি তথ্য দিতে বলা হয়। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে কাজও শুরু হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, দেশের সব ওষুধের দোকান একটি শৃঙ্খলায় নিয়ে আসতে ইতোমধ্যে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেসব দোকানের লাইসেন্স রিনিউ করা নেই, তাদের সময় দেয়া হবে। যারা লাইসেন্স ছাড়া চলছে কিন্তু দোকানের মান ভালো তাদের লাইসেন্সের আওতায় আনা হবে। আর যাদের অবস্থা একেবারেই খারাপ সেগুলোকে বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।