ভূমিকম্পে আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন প্রস্তুতি ও সচেতনতা

ভূমিকম্পে আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন প্রস্তুতি ও সচেতনতা

অমিত বণিক: তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নানা স্তরে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস প্রচেষ্টার পরও আমরা ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাসে সক্রিয় হওয়ার পরিবর্তে ধারাবাহিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থায় রয়েছি। জনসাধারণের মধ্যে ভূমিকম্পের আতঙ্ক কমাতে আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করছি না। এ ঝুঁকি হ্রাসে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। যেমন বিল্ডিং কোড প্রয়োগ, শিশুদের মধ্যে ভূমিকম্প সুরক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, স্কুল ভবন ও হাসপাতালের নির্মাণ ব্যবস্থা পরীক্ষা, কোনো ভবনের ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণ বা অবৈধ সম্প্রসারণ বন্ধ, ভূমিকম্প সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমের সঠিক প্রচার ইত্যাদি।সম্প্রতি একটি সংবাদপত্র শিরোনাম করেছে– উঁচু ভবনে মৃত্যুর ফাঁদ: ভূমিকম্পের পর ঢাকার কমপক্ষে ৫০টি ভবন হেলে পড়েছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জানিয়েছে, ২১ নভেম্বর ভূমিকম্পের পর ঢাকার কমপক্ষে ৫০টি ভবন হেলে পড়েছে বা বড় ধরনের ফাটল দেখা দিয়েছে।

কিছু সংবাদমাধ্যম এমন কিছু বিশেষজ্ঞের মতামত প্রচার করছে, যারা মানুষকে শান্ত করার পরিবর্তে সাধারণ মানুষের মতো ভবিষ্যদ্বাণী তুলে ধরছে। তাদের মধ্যে অনেকেরই ভূমিকম্প বিজ্ঞান বিষয়ে তেমন অভিজ্ঞতা নেই। অথচ তারা প্রস্তুতির ওপর আলোকপাত না করে ভূমিকম্পের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিয়ে বেশি কথা বলছেন। প্রতিটি কম্পনের পর এ ধরনের খবর জনসাধারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাত্রার আতঙ্ক তৈরি করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ড আতঙ্কের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

 

আমরা নগরবাসী ঢাকা শহরের ভূমিকম্প ঝুঁকি সম্পর্কিত অস্পষ্ট বিশ্লেষণ এবং তথ্য দেখে ভীত হয়ে পড়ছি। সত্যকে সত্য হিসেবে জানা আমাদের অধিকার। ঢাকা এবং এর নগরবাসীর মতো শহরগুলোর ভূমিকম্প ঝুঁকি সম্পর্কে স্পষ্টভাবে আশ্বস্ত করা রাষ্ট্র ও সরকারের কর্তব্য। দেশে ভূমিকম্প হলেই বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের মতামত দেখা যায়। তাদের মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুই কারণে। প্রথমত, সে বক্তব্যের আলোকে দেশের নীতিনির্ধারকরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য আমলে নিয়ে থাকে। অর্থাৎ জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে তাদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষজ্ঞরা তাদের ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা ও গবেষণার ভিত্তিতে মত দেন।

 

এতে পাঠক বা দর্শকরা খবরকে বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন। অনেক সময় খবরের তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে জটিল মনে হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সেই তথ্যকে সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা দেন। বিশেষজ্ঞ মতামত থাকলে গুজব বা ভুল ব্যাখ্যা কমে যায়। তারা তথ্য যাচাই করে সঠিক দিকনির্দেশনা দেন।ভূমিকম্প প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিঃসন্দেহে। ভূমিকম্প নিজে সাধারণত মানুষের মৃত্যু ঘটায় না। এটা হলো প্রাকৃতিক কম্পন। কিন্তু যখন ভবনগুলো ত্রুটিপূর্ণ নকশা, নিম্নমানের উপকরণ, দুর্বল কাঠামো বা অবৈধ নির্মাণে তৈরি হয়, তখনই আসল বিপর্যয় ঘটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে থামানো যায় না। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ও নিরাপদ নির্মাণের মাধ্যমে মানুষের জীবন বাঁচানো যায়। এখানে প্রাসঙ্গিক কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো– উদাহরণ ১: ২০১০ সালে ৮ দশমিক ৮ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প চিলিতে আঘাত হানে। ভূমিকম্পের ফলে সুনামির সৃষ্টি হয়, যা চিলির বেশ কয়েকটি উপকূলীয় শহরকে ধ্বংস করে দেয়; এক হাজার ভূমিধসের সৃষ্টি হয়। কিন্তু মোট মৃত্যু হয়েছিল ৫২৫ জনের এবং ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের মাত্র ৯ শতাংশ জনসংখ্যা তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছিল। চিলি এমন একটি দেশ, যেখানে নির্মাণের মান সর্বোচ্চ স্তরে বজায় রাখা হয়।

উদাহরণ ২: ২০০১ সালে ভারতের ভূজে ৭ দশমিক ৬ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প আঘাত হানে। মোট মৃত্যু হয়েছিল ২০ হাজারেরও বেশি মানুষের। ৪৪২টি গ্রামের ৭০ শতাংশ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে যায়। ভারতের গুজরাট এবং পাকিস্তানের সিন্ধুতে মোট চার লাখ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব বাড়ি ছিল হয় ইঞ্জিনিয়ারিংবিহীন নির্মাণ, নয়তো স্কুল ভবনের মতো ত্রুটিপূর্ণ।ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বহুতল ভবনসহ বিশাল আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের কোনো ভবন মালিক বা রিয়েল এস্টেট কোম্পানিকে ঝুঁকি হ্রাস বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তার জন্য দায়ী করা হয়নি।

যে কর্তৃপক্ষ শহরে ভবন নির্মাণ তদারকি করবে, তারা অবৈধ নির্মাণ বন্ধ করতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু তাদের কোনো কর্মচারীকে নিষ্ক্রিয়তা বা মৌলিক কর্তব্য পালনে অক্ষমতার কারণে আইনের আওতায় আনা হয়নি! এখন পর্যন্ত কেউ মৌলিক কর্তব্য পালনে ব্যর্থতা স্বীকার করে পদত্যাগও করেননি!
ঢাকায় ত্রুটিপূর্ণ ও অবৈধ ভবনের ছড়াছড়ি। এখানে জাতীয় বিল্ডিং কোড থাকলেও তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ হয় না। অনুমোদন ছাড়াই ভবন তৈরি হচ্ছে। অনেক জায়গায় তদারকিই নেই। সস্তা নির্মাণ উপকরণের ব্যবহার ও সঠিক ইঞ্জিনিয়ারিং না থাকায় ভবন দুর্বল হয়। ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবন বছরের পর বছর রাজউকের নজরদারির বাইরেই থেকে যায়। ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় শুধু আতঙ্কই তৈরি করে না, বরং আমাদের প্রস্তুতির সক্ষমতাকেও পরীক্ষার মুখে ফেলে। এই প্রস্তুতিতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ঘটনা ঘটার মুহূর্তে তারা তৎপরভাবে উদ্ধার, চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হলে সাধারণ মানুষ দ্রুত নিরাপদ স্থানে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র পেশাদার সংস্থার উপর নির্ভর করলেই চলবে না। এক্ষেত্রে স্কাউট, যুবসংগঠন এবং স্থানীয় কমিউনিটি দলের মতো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর প্রশিক্ষণ ও অংশগ্রহণও অত্যন্ত জরুরি। তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বয়স্ক মানুষ ও শিশুদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর দিকনির্দেশনা দিতে পারে। তাছাড়া, সাধারণ বাসিন্দাদেরও প্রাথমিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

 

ভূমিকম্পের সময় কিভাবে আশ্রয় নেবেন, জরুরি সাপ্লাই সংরক্ষণ কোথায় থাকবে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সঙ্গে যোগাযোগের সঠিক পথ কী। এই প্রস্তুতির কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে হবে। প্রত্যেক জেলা ও উপজেলায় ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতি নীতি প্রণয়ন, নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র চিহ্নিতকরণ, জরুরি যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং স্থানীয় জনগণকে প্রশিক্ষিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত জনসচেতনত সামজিক যোগাযো মধ্যম ভিডিও ও লিখিত তথ্যের মাধ্যমে শিক্ষামূলক প্রচারণা চালানো যেতে পারে।

 

এভাবে নাগরিকরা শুধু আতঙ্কিত হবে না, বরং বিপদের মুহূর্তে স্বশক্তিতে নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর সক্ষমতা অর্জন করবে। ফলশ্রুতিতে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পেশাদার প্রস্তুতি, স্কাউট ও যুব সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী সহায়তা এবং সাধারণ বাসিন্দাদের সচেতনতা একসাথে মিলিত হলে, ভূমিকম্পের প্রাকৃতিক বিপদকে যথাযথভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে এই সব ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। নাগরিকদেরও তাদের ভূমিকা বোঝা জরুরি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর বা আতঙ্ক সৃষ্টিকারী কন্টেন্ট ছড়ানো বা শেয়ার থেকে বিরত থাকতে হবে। আতঙ্কিত না হয়ে সরকারি সূত্র এবং নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যম থেকে তথ্য গ্রহণ করা উচিত। পরিবার, প্রতিবেশী ও স্থানীয় কমিউনিটির সঙ্গে সক্রিয় সংযোগ রক্ষা করলে মানুষ মানসিকভাবে আরও প্রস্তুত হতে পারে।

 

এছাড়াও, বাস্তব জীবনের উদাহরণও আমাদের শেখায় যে সচেতনতা এবং প্রস্তুতি ভয়কে মোকাবিলার শক্তি বৃদ্ধি করে। জাপান, চিলি, তুরস্কের মতো দেশগুলোতে, যেখানে ভূমিকম্প স্বাভাবিক ঘটনা, জনগণ এবং প্রশাসন আগে থেকেই প্রস্তুত থাকে। সেখানে শিক্ষামূলক সিমুলেশন, জরুরি ব্যবস্থা এবং জনসচেতনতা কার্যক্রমের ফলে আতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে থাকে। আমাদের দেশেও একই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা সম্ভব। প্রতিটি শহর, উপজেলা ও গ্রামে এই ধরনের প্রস্তুতি নিলে মানুষের জীবন এবং মানসিক শান্তি দুইই রক্ষা করা সম্ভব। বিভিন্ন গবেষণাও প্রমাণ করে, আতঙ্কিত মানুষ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, যা বিপদের সময় আরও ক্ষতি সৃষ্টি করে। তাই মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি।

 

স্কুল-কলেজে ভূমিকম্প সচেতনতামূলক ক্লাস নেওয়া, অফিস ও কারখানায় জরুরি পরিকল্পনা তৈরি করা, পরিবারকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার শিক্ষাদান এগুলো সবই জনগণকে আতঙ্কমুক্ত রাখতে সহায়ক। বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রভাবও এই আতঙ্কের সঙ্গে যুক্ত। ব্যবসায়ীরা দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে দ্বিধায় পড়ছেন, শেয়ার বাজার বা অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। এমন অবস্থায় সরকারি পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতা জরুরি। শুধু আতঙ্ক দূর করা নয়, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি, ভূমিকম্প যেমন একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, তেমনি আমাদের সচেতনতা ও প্রস্তুতি সেটিকে মোকাবেলার সক্ষমতা নির্ধারণ করে। আতঙ্ককে দূরে সরিয়ে সঠিক তথ্য, শিক্ষিত নাগরিক এবং কার্যকর প্রশাসন একত্রিত হলে আমরা নিরাপত্তা এবং মানসিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারি। সমাজ এবং সরকার একযোগে কাজ করলে আতঙ্ক কমানো সম্ভব, এবং জনগণ নিরাপদভাবে দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করতে সক্ষম হবে।

 

আজকের এই মুহূর্ত আমাদের জন্য একটি বার্তা আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনভাবে এবং সুপরিকল্পিত প্রস্তুতির মাধ্যমে আমরা ভূমিকম্পের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এটি শুধু সরকারের কাজ নয় সাধারণ জনগণও সচেতনতা, দায়িত্বশীল আচরণ এবং সহমর্মিতার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ার অংশীদার হতে হবে। একমাত্র সঠিক তথ্য, প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি মিলিত হলে ভূমিকম্পের আতঙ্ককে আমরা সামলাতে পারব, জীবন রক্ষা করতে পারব এবং মানসিক শান্তি বজায় রাখতে সচেষ্ট হবো।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

..

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::