আবুল কালম আজাদ,রাজশাহী:বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে থেকে একটু একটু করে রেলের জমি বে-দখল হতে হতে ২০২৪ সালে এসে সিংহভাগ রেলের জমি আর রেলের নাই। বে-দখল হয়ে গেছে মোট জমির ৪ ভাগের ৩ ভাগ জমি।রেল কতৃপক্ষ মাঝে মধ্যে জমি গুলো দখল মুক্ত করতে উচ্ছেদাভিযান চালালেও একটা ছটাক জমি দখলে নিতে পারেনি বা দখলে নিয়ে রাখার কোন ইতিহাস নাই রেলের।
সম্প্রতি চলতি বছরের ৫ডিসেম্বর রেলের বেদখল হওয়া ভূসম্পদ দখল মুক্ত করতে উদ্যোগ গ্রহন করেছে রেল কতৃপক্ষ।এবিষয়ে দখলদারদের নিজদায়ীত্বে তাদের পাকা,আধাপাকা স্থাপনা ১০ ডিসেম্বরের আগেই সরিয়ে নেয়ার জন্য আল্টিমেটাম দিয়েছেন রেল কতৃপক্ষ। অন্যথায় কঠিন পদক্ষেপ নিবেন বলে হুশিয়ারীও দিয়েছেন।
রেলের জায়গা দখল মুক্ত করার কতৃপক্ষের এই হুঙ্কার কতটা বাস্তবায়ন হবে সেটা ১০ ডিসেম্বরের পরে জানা যাবে।
★পশ্চিমাঞ্চল রেলের পরিধি:-
উত্তরে পঞ্চগড় থেকে দক্ষিণে বাগেরহাট এবং পূর্বে গাজীপুর থেকে পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়াও রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও ঢাকা বিভাগের টাঙ্গাইল, বৃহত্তর ফরিদপুর, আংশিক গাজীপুর এবং ময়মনসিংহ বিভাগের অর্ধেকাংশ সেকশন লাইন রেলওয়ে পশ্চিম জোনের অধিভুক্ত।
★বেদখল হওয়া জমির পরিসংখন:-
পশ্চিম রেলের সবচেয়ে বেশি জমি রয়েছে সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, লালমনিরহাট, সান্তাহার, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ঈশ্বরদী, পাকশী, রাজবাড়ী ও চুয়াডাঙ্গা জেলায়। এসব এলাকায় বে- দখলের পরিমাণও অনেক বেশি।
তথ্যমতে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার ৪১৯ একর। এর বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন প্রকল্পের আরও সাড়ে তিন হাজার একর জমি। রেলের পরিত্যক্ত ও অব্যবহৃত প্রায় ১২ হাজার একর জমি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়া রয়েছে। এসব ইজারা বাবদ পশ্চিম রেল সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ২৭ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে।
★লিজ দেয়া জমির পরিমান:-
পশ্চিমাঞ্চল রেল ভূ-সম্পত্তি বিভাগের তথ্যমতে, সৈয়দপুর পৌরসভার যোগসাজশে বিপুল পরিমাণ জমি দখল করে রাখা হয়েছে। রেল সূত্রে দাবি, ১৯৭৯ সালে রেলের ২৫ একর ৫০ শতক জমির লাইসেন্স ফি তোলার দায়িত্ব নেয় সৈয়দপুর পৌরসভা।
চুক্তি অনুযায়ী লাইসেন্স ফির অংশ পৌরসভা ও রেলের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন হওয়ার কথা ছিল। প্রথম বছর রেলকে কিছু রাজস্ব দিলেও পৌরসভা পরে আর কোন টাকাও দেয়নি। নথিতে জায়গা ২৫ একর হলেও সৈয়দপুরে ২ শতাধিক একর জমি পৌরসভার ছত্রছায়ায় দখলদারদের হাতে চলে গেছে।
★বেশি জমি বেদখল হওয়া জেলা:-
রেল সূত্রে আরও জানা গেছে, রেলেওয়ের পুরো পশ্চিমাঞ্চজুড়ে রেলের জমি সবচেয়ে দখল হয়েছে আটটি জেলায়। এর মধ্যে সৈয়দপুরে আড়াই হাজার বিঘা, সিরাজগঞ্জের দুই হাজার বিঘা, রাজশাহীতে দেড় হাজার বিঘা, রাজবাড়ীতে দুই হাজার বিঘা, লালমনিরহাটে আড়াই হাজার বিঘা, চুয়াডাঙ্গা, ঈশ্বরদী ও পাকশীতে দেড় হাজার একর করে জমি বেদখল রয়েছে।
এছাড়া সান্তাহার জংশন, বগুড়া, খুলনা, কুষ্টিয়া, গোয়ালন্দঘাট, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, যশোর ও গাইবান্ধার বোনারপাড়া ও ফুলছড়ি ঘাট দিনাজপুরের পার্বতীপুর এলাকায় বিপুল পরিমাণ রেলভূমি বেহাত হয়ে রয়েছে।
★আমনুরা-গোদাগাড়ী সসেকশন পুরো বেদখল:-
অন্যদিকে পশ্চিম রেলের আমনুরা
গোদাগাড়ী সেকশন রেললাইনটি ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরপরই বন্ধ করা হয়। ১৯২৩ সালে নির্মিত ২৫ দশমিক ৮৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেকশনে রেলের মোট জমির পরিমাণ ৭২০ একর। যার বর্তমান বাজার মূল্যে এ জমির পরিমাণ প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ এ জমির এক ছটাকও রেলের হাতে নেই। পুরোটাই বেদখলে রয়েছে। আইন না থাকলেও এসব জমি একের পরে এক হাতবদল হচ্ছে।
সম্প্রতি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, রেলওয়ের নিকট কোন অনুমোদন না নিয়েই,গায়ের জোরে আমনুরা-গোদাগাড়ীর রেলবাজার পর্যন্ত পরিত্যক্ত রেললাইনটির ওপর দিয়ে পাকা সড়ক করেছে।
এভাবেই পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে রেলের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে।এসব জমি উদ্ধারে রেল কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
★ভূসম্পত্তি কর্মকর্তাদের বক্তব্য:-
তবে -প্রধান ভূসম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন,লোকবল সংকট ও অর্থ না থাকায় তারা বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে অভিযানে নামতে পারছেন না।এছাড়া সরকারী রাজনৈতিক দলীয় নেতাদের প্রভাব ও রেলের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও পরোক্ষ ও প্রতক্ষ্য ইন্ধনও রেলের ভূসম্পদ উদ্ধারের পরে দখলে রাখতে পারছেনা রেল।
★লোকবল সংকট:-
রেল সূত্রের দাবি, পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বে একজন প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা, তিনজন বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা, তিনজন সহকারী ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা, চারজন সার্কেল কর্মকর্তা, ৯ জন কানুনগো, ১৮ জন আমিন, তিনজন মামলা পরিদর্শক, চারজন ট্রেসারসহ কয়েকজন কর্মচারী রয়েছেন। বিপুল পরিমাণ এই সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য বিদ্যমান জনবলের চারগুণ বেশি প্রয়োজন।
★সীমাবদ্ধতা ও অর্থ সংকট :-
পশ্চিম রেলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা (অতিঃ দায়ীত্ব) মাহমুদা পারভিন বলেন, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ অভিযানে গেলেই দখলদাররা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে হাজির হন। এস্টেট শাখায় মামলা পরিদর্শকের অভাবে এসব মামলার সার্বক্ষণিক তদারকি করা যায় না।
এছাড়া দখলদারদের বিরুদ্ধে থানা পুলিশ মামলা নেয় না। আদালতে গেলেও মামলা পরিদর্শকের সঙ্গে সমন্বয়ের অভাবে মামলা করা যায় না। এ কর্মকর্তা আরও বলেন, মামলা আদালতে উঠলেও রেলের নিযুক্ত আইনজীবীরা নানা অজুহাতে গুরুত্ব দেননা। কারণ রেলের মামলা পরিচালনা করে আইনজীবীরা যথা সামান্য পরিমাণ ফি পান। ফলে রেলের সম্পত্তি বিভাগের জন্য যোগ্য আইনজীবীও পাওয়া যায় না।
পশ্চিম রেলের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) অন্যতম প্রধান দায়িত্ব রেলওয়ের সম্পদ ও সম্পত্তি রক্ষা করা। কিন্তু সম্পত্তি রক্ষায় তাদের বিশেষ কোনো ভূমিকা দেখা যায় না। দখলদারদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে স্থানীয় সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনও যথাযথ ভূমিকা পালন করে না। কোথাও দখলদার উচ্ছেদে গেলে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ পাওয়া যায় না।
এছাড়া,রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) ভূমিকাও প্রায় একই রকম। এছাড়া দখলদার উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম নেই রেলের। উচ্ছেদ খাতে বিপুল খরচ হলেও বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এ বরাদ্দে উচ্ছেদ যন্ত্রপাতির ভাড়ার টাকাও হয় না।
★নজরদারিতে গাফিলতি:-
পাকশীতে দখল করা জমির মধ্যে ২ হাজার ৫৮ একরই বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের দখলে। লালমনিরহাটে রেলের ৮৪১ একর জমি বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে আছে। এসব এলাকায় রেলের জায়গা দখল করে মার্কেট, এমনকি রিসোর্টও বানানো হয়েছে।
★জমি উদ্ধারে ব্যবস্থা নেয় না রেল:-
বর্তমানে রেলওয়ের ১৩ হাজার ২৩ একর জমি ইজারা দেওয়া আছে। আর ১২ হাজার একর জমি অব্যবহৃত পড়ে আছে। অভিযোগ আছে, রেল কর্তৃপক্ষই তাদের জমি উদ্ধারে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। বিশেষ করে জমি উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর জন্য যে পরিমাণ বরাদ্দ দরকার, তা দেওয়া হয় না। ১৯৭৬ সালে রেলওয়েতে পৃথকভাবে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তার কার্যালয় করে যে জনবলকাঠামো করা হয়, সেই জনবলও নেই। বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলে জনবলের অভাবে ৯২ থেকে ৯৩ শতাংশ সম্পদের ওপরই রেলওয়ের নিয়ন্ত্রণ নেই।
পশ্চিমাঞ্চলের বিভাগীয় ভূসম্পদ কর্মকর্তার (সদর)০১৭১১৬৯২৯৮৪ নাম্বারে কল করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রেলের কোটি কোটি টাকার সম্পদ বেদখল হয়ে যাচ্ছে। অথচ শুধু সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা থেকেই শত শত কোটি টাকা আয় করতে পারত রেল। কিন্তু আমাদের সম্পদ রক্ষার জন্য জনবল নেই। উচ্ছেদ অভিযান চালানোর জন্য বছরে মাত্র দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এই টাকা দিয়ে কয়টা অভিযান চালানো সম্ভব? সমস্যাগুলোর সমাধান করা গেলে আমরাই বছরে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা আয় করতে পারতাম।’
★অসহায় এই বিভাগ:-
পশ্চিমাঞ্চলে কোথায় কোথায় রেলের সম্পদ দখল হয়ে আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সৈয়দপুর শহরে আমাদের ১২ আনা জমিই দখলে। শুধু পৌরসভাই শহরের কেন্দ্রে ২৫ একর জমি দখল করে রেখেছে। লালমনিরহাট, বগুড়া, রংপুর, কুষ্টিয়ায় অনেক জায়গা দখল হয়ে আছে। যে যেভাবে পারছে দখল করে রেখেছে। আমার মনে হয়, রেলের ভূ-সম্পত্তি শাখার চেয়ে অসহায় কেউ নেই।’
‘রেলের অনেক জায়গাই দখল হয়ে আছে। আমরা সাধ্যমতো উচ্ছেদ অভিযান চালানোর চেষ্টা করি। কিন্তু জনবল ও অর্থের সংকট। তবু আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।’