অদক্ষশ্রমিক, অব্যবস্থাপনা ও দূর্নীতিতে নিমজ্জিত রেল

অদক্ষশ্রমিক, অব্যবস্থাপনা ও দূর্নীতিতে নিমজ্জিত রেল
আবুল কালাম আজাদ,রাজশাহী: প্রাচীনতম ঐতিহ্যের ধারক বাহক, সাশ্রয়ী, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বাহন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক, সহিংসতাসহ রাষ্ট্রীয় যে কোনো বিপর্যয়ে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে রেল। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে সরকারি যাবতীয় পরিবহন ব্যবস্থা বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রীর পরিবহন নির্ভর ছিল।
তৎকালীন  সময় রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি সমন্বয়করণের প্রয়োজনে রেলওয়ের  ব্যবস্থাপনা সেবা খাত ও বাণিজ্যিক খাত দুভাগে বিভক্ত ছিলো।  সে সময় বাংলাদেশ রেলওয়ে পরিচালিত হয় বোর্ডের মাধ্যমে।
১৯৮২ সালে রেলওয়ের বোর্ড পদ্ধতি বাতিল করে মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হলে, দাতা সংস্থার পরামর্শে সেবাখাতটি বহাল রেখে বাণিজ্যিক খাত বন্ধ করা হয়। তখন থেকেই লাভ জনক প্রতিষ্ঠানটি লোকসানের খাতে পরিণত হয়। শুরু হয় রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এই যোগাযোগ ব্যবস্থা রেলকে লুটপাট করে ধ্বংস করার চক্রান্ত।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ট্রেন গুলোকে বেসরকারি করণের নামে লুটপাট,’গোল্ডেন হ্যান্ড শেফ’ এর মাধ্যমে বিদায় করা হয় কয়েক হাজার দক্ষ রেল শ্রমিককে। যাতে রেল পরিচালনা কাস্টসাধ্য হয়ে পড়ে এবং লুটেরা বণিক শ্রেণি লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করতে পারে।
রেলকে ধ্বংস করার বিষয়টি রেলওয়ের শ্রমিক-কর্মচারী বুজতে পেরে, রেলকে রক্ষার জন্য ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে।এক সময়ে সরকার বাধ্য হয় বেসরকারি নীতি পরিহার করতে।
রেলের নিয়োগ একটি চলমান প্রক্রিয়া:- ১৯৮৫ সালের নিয়োগ বিধি/৮৫ প্রবর্তন করে চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। যার কারণে দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরির প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৫ সাল থেকে হটাৎ করে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়,,যার ফলে শূন্য পদে সাবস্টিটিউট নিয়োগ বন্ধ হওয়ায় ব্যাপক দক্ষ জনবলের ঘাটতি চলতে থাকে। ফলে রেলের ৬৮ হাজার লোকবল থেকে নেমে ৪০ হাজারে নেমে আসে।
অন্যদিকে  কর্মকর্তার পদ সংখ্যা ৪/৫ গুণ বৃদ্ধি করে মাথাভার প্রশাসন তৈরি করা হয়। অপরদিকে শ্রমশক্তি বহুলাংশে হ্রাস করা হয়।
১৫ বছর পর ২০০০ সাল থেকে চতূর্থ তৃতীয় পদের কিছু সংখ্যক লোকবল নিয়োগ হলেও নির্ধারিত কাজের উপযোগী দক্ষ লোকবল নিয়োগ করা হয় নাই। এছাড়া নবনিয়োগ প্রাপ্তদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না দিয়েই লোকবল সংকটের কারন দেখিয়ে তদেরকে জন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব দেয়া হয়। অন্যদিকে মাঠপর্যায়ের কর্মচারীদের নির্ধারিত বিশ্রাম না দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্যককরা হয় ফলে অতিরিক্ত কাজ করায় এসব শ্রমিকের শারীরিক, মানসিক সক্ষমতা হ্রাস ও কাজে মনোবল হারিয়ে ফেলায় ট্রেন প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় পতিত হতে৷ থাকে।
রেল হচ্ছে ‘টেকনিক্যাল জব’ এরিয়া:- ট্রেন পরিলনা হয় সুদক্ষ শ্রমিকের টেকনিক্যাল দক্ষতায়। এক্ষেত্রে  অফিসিয়াল কাজ ছাড়া সর্বক্ষেত্রে কর্মচারীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ শ্রমিক গড়েতোলা।
তৎকালীন সময়ে রেলের নিয়োগ প্রক্রিয়ার রেলের স্বার্থ  না দেখে  অর্থ বানিজ্যের প্লাটফরম তৈরী করে কতৃপক্ষ।  রাজনৈতিক প্রভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মূলনীতি অনুসরণ করা হয়,এবং এটাকে পুজি করে সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তারা নিয়োগ বানিজ্যে নেমে পড়ে।এছাড়া শ্রেণিভিত্তিক নিয়োগ কর্মকর্তা নিয়োগে প্রেসিডেন্ট অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে নির্ধারণ থাকলেও তখন তা মানা হয় নাই। কাজের ধরন অনুযায়ী লোকবল নিয়োগের বিধান থাকলেও তা মানা হয় নাই।
নিয়োগ বিধিতে বয়স সীমালঙ্গন করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৪০ উর্দ্ধ বয়সের লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে।সে সময় দেখা গেছে ৫৫ বছরের বৃদ্ধাকে নিয়োগ দেয়ার নজির চোখে পড়ার মতো ছিলো।
 অস্বাভাবিক দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অনৈতিকতার মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ার কারণে রেলওয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ যাদেরই নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদেরকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণও দেয়া হয় নাই। তাছাড়া নবনিয়োগে বেশিরভাগ লোকই সমাজের চিহ্নিত সন্ত্রাসী, নেশাখোর, মাদক ব্যবসায়ী, খুনি ও একাধিক মামলার আসামি ছিলো।
অন্যদিকে অর্থের  বিনিময়ে ও সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়োগ প্রাপ্তরা রাতারাতি সরকারি দলের বড় নেতা হয়েছে।
তারা কাজ না করে দলবেঁধে  বড় নেতাদের পেছনে ঘুরে বেড়ায়, আর সকল অপকর্ম দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়ে। যার কারণে অনভিজ্ঞ, • দায়িত্বহীন, মেধাশূন্যতার বিশাল জনশক্তি রেলকে দিনে দিনে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এদের এখনই  লাগাম  ধরত না পারলে রেলকে অদূর ভবিষ্যতে আরো কঠিন ভয়াবহতার সম্মুখীন হতে হবে।
এ ভয়াবহতা থেকে উত্তরণের জন্য এখনি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।
প্রকৌশলী বিভাগের নাজুক অবস্থা:-
 প্রকৌশল বিভাগের অবস্থা একেবারে নাজুক পর্যায়ে। নতুন রেললাইন নির্মাণে অসংখ্য প্রকল্প চলমান থাকলেও, পুরাতন রেললাইনের অবস্থা খুবই নাজুক এবং ঝুঁকিপূর্ণ। যাত্রী সেবার মান উন্নয়নে দ্রুত সময়ে যাতায়াতের দিকে ধাবিত হওয়ায় রেলওয়েতে দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।  বর্তমানে বিদ্যমান রেল লাইনগুলি স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে তৈরি করা। দেশি ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কারণে দীর্ঘ সময়ধরে রেললাইন গুলোতে তেমন কোন সংস্কার করা হয় নাই।
লাইনের স্থায়িত্বের মেয়াদ বহু পূর্বে শেষ হয়েছে। লাইনের ফিটিংস লোকাল পার্সেসের মাধ্যমে নিম্নমানের হওয়ায় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়।
এক সময় রেল লাইনে দেয়া কাঠের স্লিপার গুলো নিজ ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম কাঞ্চন নগর ডিপোতে অয়েল ট্রিয়েটেড করে রেললাইনে লাগানো হতো। বর্তমানে ঐ ডিপোর কার্যক্রম বন্ধ করে ঠিকাদারের মাধ্যমে স্লিপার সরবরাহ করা হচ্ছে।
ফলে সরবরাহ করা স্লীপারে অয়েল ট্রিয়েটেড করার কথা থাকলেও তা কখনই করা হয় না এছাড়া সেগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের কাঠের।যার ফলে অনেকাংশে লাইনে লাগানোর পূর্বেই স্লীপার সাঁতা পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
রেললাইনের ফিটিংস:
 পি-ওয়ের সর্বত্র রেললাইনের ফিটিংস পয়েন্টস অ্যান্ড ক্রসিং স্লিপার ঘাটতি আছে। ফলে প্রতিটি পি-ওয়ে সেকশন অত্যাধিক ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন পরিচালনা করছে রেল।
 রেল লাইন তদারকির অভাব: 
রেল লাইনে সুপার ভাইজিং অথরিটি নাই বললেই চলে। এসএই/ওয়েতে নব নিয়োগ প্রাপ্তদের কোনোরকম প্রশিক্ষণ না দিয়েই তাদের পূর্ণ নায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। পাশাপাশি নবনিয়োগ প্রাপ্ত লাইনের কর্মচারীদের ব্যাপক শূন্যতার কারণে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যাদের কোনো রকম রেলপথ রক্ষণা বেক্ষণ সম্পর্কে কোন ধারণা নাই।
 সঠিক সময়ে নিয়োগ না দেয়ার কারণে রেল লাইনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী এসএসএই/ওয়ে বর্তমানে প্রায় শূন্যের কোঠায়।ইচ্ছা থাকলেও অভিজ্ঞতা ছাড়া রেললাইন রক্ষণা বেক্ষণ,করা সম্ভব নেয়।
 গুরুত্বপূর্ণ কাজটি প্রশিক্ষ বিহিন ম্যান পাওয়ার দিয়ে কাজ করালে তাতে ত্রুটি থাকে ফলে প্রতিনিয়ত ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে।  এ বিষয়গুলি তিন কর্তৃপক্ষ উদাসীনতা।   অনেক রেল সেতু আছে বহু পুরাতন,  সংস্কারের অভাবে সেতুগুলোতে ঝুঁকি নিয়ে চলছে ট্রেন।
প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রশাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী জায়গাটা অভিজ্ঞতাহীন ও মেধাশূন্যতায়
 পরিপূর্ণ।প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হচ্ছে জননিরাপত্তা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটি। রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেলওয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে ভূমিকা রাখছে। পরিবেশ দুষণরোধ, যাতায়াতে নিরাপত্তা, স্বল্প খরচে মালামাল পরিবহন, ভূমির পরিমিত ব্যবস্থায় যানজট নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বোপরি নগরের সঙ্গে গ্রামের সেতু বন্ধনের মাধ্যমে রেলওয়ের গুরুত্ব অনেক।
এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলওয়েকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। উন্নয়ন বাজেটেও অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে রেলকে। এর পরেও প্রতিষ্ঠানটির তেমন কোনো সুফল মিলছে না। একের পর এক স্টেশন বন্ধ, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন, রোলিং স্টক, জরাজীর্ণ রেল কারখানা ও রেল লাইন, ব্রিটিশ আমলের তৈরি রেল সেতুগুলি জরাজীর্ণতা, পয়েন্টস এন্ড ক্রসিং মেয়াদোত্তীর্ণ ও ক্ষয়প্রাপ্ত, অসংখ্য অবৈধ আনম্যান লেভেল ক্রসিং গেইট ও সিগ্যালিং ত্রুটিসহ নানা কারণে রেলপথে অহরহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে।
রেলপথের বড় সমস্যা হচ্ছে রেলওয়ের সংশ্লিষ্টদের অবহেলা, অনভিজ্ঞতা, লোকবলের ঘাটতি, নিয়মিত তদারকি ও মেয়ামতের অভাব। অন্যদিকে  রেল লাইনে মানসম্মত ও পরিমাণমত পাথরের স্বল্পতা এবং ব্যাপক দুর্নীতি।
সম্প্রতি আন্তঃনগর ট্রেনসহ সকল ট্রেনের গতি বাড়ানো হলেও আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা সর্বত্র চালু করা হয় নাই। ফলে সিগন্যালিং সংকটেও ট্রেন দুর্ঘটনার  কারণ।
এগুলোকে আধুনিক ও যুগপোযোগী করা জরুরি।
ভূসম্পদ বিভাগ:
রেলওয়ের  আরেক দুর্নীতির বড় ক্ষেত্র হল ভূ-সম্পত্তি বিভাগ। ১৯৮২ সালের পূর্বে রেলওয়ে বোর্ড থাকাকলীন সময়ে ভূ-সম্পত্তি বিভাগ,  প্রকৌশল বিভাগের আওতায় ছিলো। ১৯৮২ সালের পর তা ভূ-সম্পত্তি বিভাগকে পৃথক করা হয়। তখন থেকেই এই বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীরা যোগসাজশে সিন্ডিকেট গড়ে  রেলওয়ের বিশাল পরিমাণের জায়গা বিভিন্ন কৈশলে দখল করে নেয়।  বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীরাই বিভিন্ন কৌশল দখলদারদের ভূমি দখলে সহায়তা করে। যেমন ক্ষতিপূরণ লাইসেন্স প্রদান, কৃষি, বাণিজ্যসহ অন্যান্য লাইসেন্সের নামে রেলের ভূমি বহিরাগত দখলদারদের হাতে তুলে দেয়া তাদের মূল কাজ। তাছাড়া রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে বহু সম্পত্তি বেদখল হয়। এতেকরে রেলওয়ে বিশাল রাজস্ব থেকে বাঞ্ছিত হচ্ছে।
 বর্তমানে রেলওয়ের ভূমি অবৈধ দখলমুক্ত করতে জোরদার অভিযান চলমান রেখে রেলকতৃপক্ষ। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে নানান জটিললতায় হাজার হাজার একর ভূমি উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছেনা। এছাড়া  উচ্ছেদেও কিছু অসাধু কর্মকর্তার৷ সদিচ্ছা বহুলাংশে দায়ী। মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ের মাধ্যমে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ হচ্ছে না। বিষয়টা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::