আবুল কালাম আজাদ,রাজশাহী: কৃষিপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে পরিবহন ব্যয় কমাতে একটি বিশেষ ট্রেন চালু করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ‘কৃষিপণ্য স্পেশাল’ নামের এ ট্রেনটিতে সংযুক্ত করা হয় সাতটি লাগেজ ভ্যান, যার মধ্যে একটি ছিল রেফ্রিজারেটেড। ঢাকা-খুলনা রুটে গত ২২ অক্টোবর প্রথম ট্রেনটি পরিচালনা করা হয়। সেই ট্রিপে পণ্য পরিবহন করা হয় ১ হাজার ৮৬০ কেজি। এতে রেলের আয় হয় ২ হাজার ৩২০ টাকা।
২৪ অক্টোবর একই ট্রেন পরিচালনা করা হয় পঞ্চগড়-ঢাকা রুটে। ৭৬০ কেজি কৃষিপণ্য পরিবহন করে এ ট্রিপে রেলওয়ে পায় ১ হাজার ২৯৬ টাকা। রহনপুর-ঢাকা রুটে ২৬ অক্টোবর পরিচালনা করা ট্রেনটিতে বুকিং হয় মাত্র ২৬০ কেজি কৃষিপণ্য। আয় আসে ৪৮২ টাকা। ‘কৃষিপণ্য স্পেশাল’ সর্বশেষ ২৯ অক্টোবর ঢাকা-খুলনা রুটে দ্বিতীয়বার চলে। ১ হাজার ২২৫ কেজি কৃষিপণ্য পরিবহন করে রেলওয়ে পায় মাত্র ১ হাজার ৯১০ টাকা।
দেশের তিনটি রুটে চারদিন কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন পরিচালনা করে বাংলাদেশ রেলওয়ে সব মিলিয়ে পেয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৮ টাকা। বিপরীতে ট্রেন পরিচালনা করতে গিয়ে সংস্থাটিকে গুনতে হয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকা। প্রত্যাশিত কৃষিপণ্য না পেয়ে এবং ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহের কারণে এরই মধ্যে পঞ্চগড়-ঢাকা ও রহনপুর-ঢাকা রুটে বিশেষ এ ট্রেনটির চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। লোকসানের কারণে খুলনা-ঢাকা রুটেও ট্রেনটি বন্ধ করে দেয়ার জন্য রেল ভবনে সুপারিশ করেছে পশ্চিমাঞ্চল রেলের বাণিজ্যিক কার্যালয়। আজই এ বিষয়ে নির্দেশনা পেয়ে যাবেন বলে আশা করছেন পশ্চিম রেলের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার সুজিত কুমার বিশ্বাস।
খুলনা থেকে ঢাকা পর্যন্ত প্রতি কেজি পণ্য বহনে খরচ পড়ত ১ টাকা ৪৭ পয়সা। এরপরও ব্যবসায়ীদের অনীহার কারণে ট্রেনটি বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে সুজিত কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য বিশেষ এ ট্রেনটি চালু করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া পাইনি। এ কারণে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।’
লোকসানের কারণে কৃষিপণ্য স্পেশাল বন্ধ করে দেয়া হলেও ‘ম্যাঙ্গো স্পেশাল’ ও ‘ক্যাটেল স্পেশাল’ নামের ট্রেন দুটিকে মৌসুম ধরে পরিচালনা করছে রেলওয়ে। যদিও আম ও পশু পরিবহন করেছে এখন পর্যন্ত হাতেগোনা। এ ট্রেন দুটিও পরিচালনায় আয়ের চেয়ে ব্যয় গুনতে হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি।
কৃষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্রেনের চেয়ে ট্রাকে পণ্য পরিবহন তুলনামূলক সহজ ও ঝামেলামুক্ত। কৃষক পর্যায়ে এজন্য খুব বেশি ব্যয়ও হয় না। মূলত এ কারণেই ট্রেনে কৃষিপণ্য পরিবহন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে না। এ বিষয়ে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট সুলতান মাহমুদ সুমন বলেন, ‘রাজশাহী থেকে শাকসবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধসহ বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। ব্যবসায়ীরা ট্রাক বা সহজলভ্য পরিবহন ভাড়া করে কৃষকের পণ্য মাঠ থেকেই সংগ্রহ করেন। এজন্য কৃষকদের অতিরিক্ত কোনো পয়সা খরচ হয় না। বিপরীতে ট্রেনে পরিবহনের ক্ষেত্রে কৃষিপণ্য লোডিং-আনলোডিংয়ের খরচ রয়েছে। স্টেশনে আনা-নেয়ার ব্যাপার আছে। এতে যেমন পয়সা খরচ হয়, তেমনি কৃষিপণ্য নষ্ট হওয়ারও ঝুঁকি আছে। এজন্য কৃষকরা ট্রেনে পণ্য পরিবহনে আগ্রহ পান না।’
বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থায় পণ্যের দাম নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে মধ্যস্বত্বভোগীদের। এ শ্রেণীকে এড়িয়ে স্বল্প খরচে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বাজার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে রেলের বিশেষ ট্রেন পরিচালনার উদ্যোগকে ইতিবাচক বলেই মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতায় এসব উদ্যোগ ব্যর্থতায় রূপ নিচ্ছে।
রেলের বিশেষ ট্রেনগুলো দেশের বাজারে কৃষিপণ্যের মূল্য সহনীয় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত বলে মনে করেন রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) অধ্যাপক ড. আব্দুর রাজ্জাক। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের বাজার ব্যবস্থায় ফড়িয়া বা মধ্যস্বত্বভোগীরা সবচেয়ে বেশি মুনাফা ভোগ করে। তাদের কারণে কৃষক পণ্যের কাঙ্ক্ষিত দাম পান না, আবার ভোক্তাকে পণ্যের জন্য বেশি দাম দিতে হয়। পণ্য পরিবহনের বিশেষ ট্রেনগুলো দিয়ে এ ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার একটা ভালো সুযোগ ছিল।’
রেলের উদ্যোগ ভালো হলেও সেটি বাস্তবায়নে নানা ধরনের অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা রয়েছে জানিয়ে ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘এখানে শুধু কৃষকের পণ্য এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছানোর দিকেই নজর দেয়া হয়েছে। মাঠ থেকে পণ্য কীভাবে স্টেশনে আসবে এবং স্টেশন থেকে কীভাবে সেগুলো পাইকারি বাজার পর্যন্ত যাবে, সে ব্যাপারটি মাথায় নেয়া হয়নি। আমি মনে করি, যথাযথ সমীক্ষা ও পরিকল্পনা এবং রেল ও সড়কপথের সমন্বয় করে বাস্তবায়ন হলে পণ্য পরিবহনের এ উদ্যোগগুলো অবশ্যই সফল হতো।’
তিনি আরো বলেন, পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রেন চালুর আগে সমীক্ষা ও পরিকল্পনার ওপর গুরুত্ব দিলেও রেলের উদ্যোগগুলোয় তা উপেক্ষিত থেকেছে। কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন চালুর আগে কোনো ধরনের সমীক্ষা করা হয়েছিল কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে
পশ্চিম রেলের প্রধান বানিজ্যিক কর্মকর্তা সুজিত বিশ্বাস বলেন, ‘এটা আসলে সমীক্ষার বিষয় না। বাজারে জিনিসপত্রের মূল্য অনেক বেশি। এটা কমিয়ে আনতে রেল যেন ভূমিকা রাখতে পারে, সেজন্যই ট্রেনটি চালু করা হয়। আমরা কিন্তু এখানে ব্যবসা করতে নামিনি। চালুর আগে বিভিন্ন হাটবাজারে ব্যবসায়ী ও মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি,মাইকিং করা হয়েছে,এছাড়া মিডিয়ায় প্রচারের জন্য মিডিয়া কর্মীদের সাথে মতবিনিময় করাসহ এই ট্রেনটি চালুর আগে সব ধরনে প্রচার প্রচারনা চালিয়েছি।
আম পরিবহনের জন্য ২০২০ সাল থেকে ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেন পরিচালনা করছে রেলওয়ে। চালুর পর চার বছরে ট্রেনটি পরিচালনা করতে গিয়ে সংস্থাটির লোকসান হয়েছে ১ কোটি টাকার বেশি। একইভাবে লোকসান গুনেছে কোরবানির পশু পরিবহনের ট্রেন ক্যাটেল স্পেশাল। শুধু বিশেষ ট্রেন নয়, কৃষিপণ্য পরিবহনে বিভিন্ন রুটের যাত্রীবাহী ট্রেনের সঙ্গেও লাগেজ ভ্যান সংযুক্ত করেছে রেলওয়ে। এজন্য ৩৫৮ কোটি টাকা খরচ করে কেনা হয়েছে ১২৫টি লাগেজ ভ্যান। এসব পণ্যবাহী কোচ রেলের বহরে যোগ হওয়ার পর রেলের আয় বৃদ্ধির বদলে উল্টো কমেছে। ২০২৩ সালে রেলের বহরে ছিল ৫১টি পুরনো লাগেজ ভ্যান, যা দিয়ে ওই বছরের আগস্ট পর্যন্ত সংস্থাটি আয় করে প্রায় ১০ কোটি টাকা। চলতি বছর তিন ধাপে রেলে ১২৫টি নতুন লাগেজ ভ্যান যুক্ত হলেও গত আগস্ট পর্যন্ত আয় হয়েছে ৮ কোটি টাকার কিছু বেশি। বিভিন্ন ট্রেনে সংযুক্ত লাগেজ ভ্যানগুলো বেশির ভাগ সময়ই ফাঁকা থাকছে।
কৃষকের পণ্য কম খরচে পরিবহনের লক্ষ্য নিয়ে বিশেষ ট্রেন ও বিভিন্ন ট্রেনে লাগেজ ভ্যানগুলো সংযোজনের উদ্যোগ নিয়েছিল রেলওয়ে। যদিও রেলের এ উদ্যোগের ধারণাটিকেই ভুল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একজন প্রান্তিক কৃষক কতটুকুই-বা পণ্য উৎপাদন করেন? আধা টন বা সর্বোচ্চ এক টন। প্রান্তিক কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য রেল স্টেশন পর্যন্ত আনতে একটা খরচ হয়। সেই পণ্য ট্রেনে তুলতে ও নামাতে কুলি খরচ আছে। খরচের পাশাপাশি স্টেশনের কুলি সিন্ডিকেটের কারণে বিড়ম্বনা আছে। স্টেশন থেকে বাজারে নিয়ে আসতে আবার খরচ। এত খরচ আর ঝক্কি-ঝামেলা ছোট কৃষকরা কখনই নিতে চাইবেন না। ফলে কখনই এসব ট্রেন পরিচালনার উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। যারা নতুন ট্রেন বা ট্রেনে লাগেজ ভ্যান যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে, আমি বলব তাদের হয়তো এ বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই।’