বিচার ব্যবস্থায় দেশের দরিদ্র মানুষের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত ও সহজ করতেই গঠন করা হয়েছে গ্রাম আদালত। গ্রামের দরিদ্র মানুষ যাতে সহজে ও নামমাত্র খরচে তাদের এই অধিকার রক্ষা বা প্রতিষ্ঠা করতে পারে, সেজন্যেই গ্রাম আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ আদালতে গ্রামের ছোটখাটো বিরোধ বড় আকার ধারণ করার আগেই সহজে নিষ্পত্তি করা সম্ভব । ১ জন চেয়ারম্যান এবং বিবাদের প্রত্যেক পক্ষ কর্তৃক মনোনীত দুজন সদস্য নিয়ে মোট ৫ জন সদস্য নিয়ে গ্রাম আদালত গঠিত হয়। এ ৫ জন সদস্য গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ এবং গ্রাম আদালত বিধিমালা ২০১৬ অনুযায়ী কতিপয় অপরাধের দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে একদিকে বাংলাদেশের মূলধারার বিচারব্যবস্থার উপর যেমন চাপ কমাচ্ছেন তেমনি স্থানীয়ভাবে জনগণের ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত করছেন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকার গ্রাম আদালতকে গ্রহণযোগ্য এবং কার্যকর করে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য সোচ্চার।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান বলেন, এ লক্ষ্যে এ আইনে জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো যায় কি না সরকার তা’ ভেবে দেখছে এবং অধিকসংখ্যক অপরাধ অন্তর্ভুক্ত করে অপরাধ দমনের টেকসই পথ চিন্তা করছে। গ্রাম আদালত অবেক্ষণের অংশ হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ হতে প্রতিমাসে সারাদেশের প্রতিটি জেলার গ্রাম আদালতসমূহে মামলা নিষ্পত্তির পর্যালোচনা করা হয়।
ফেব্রুয়ারি ২০২৪ এর পর্যালোচনা অনুযায়ী দেখা যায়, মাদারীপুর জেলায় সর্বোচ্চ সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে এবং সারাদেশে প্রথম স্থান অধিকার করে। এ সাফল্যে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান এর কার্যকর দিকনির্দেশনা এবং আদালতসমূহের সঠিক তত্ত্বাবধান এ সাফল্যের মূলমন্ত্র বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে, জেলা প্রশাসক এ সাফল্যের মূল কারিগর হিসেবে জেলার সকল ইউনিয়ন এর চেয়ারম্যানগণকে কৃতিত্ব দিয়েছেন এবং সরকারের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। একই সাথে তিনি সরকারি কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধিদের সুন্দর মিথস্ক্রিয়ার জন্য ইউএনও এবং উপপরিচালক, স্থানীয় সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
এ ব্যাপারে মাদারীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক নুসরাত আজমেরী হক বলেন, গ্রাম আদালতকে সক্রীয়করণের মাধ্যমে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং এ বিষয় এ সরকার কর্তৃক গৃহীত সকল পদক্ষেপ বাস্তবায়নে মাদারীপুর জেলার সম্মানিত জেলা প্রশাসক স্যার এর নির্দেশনায় মাদারীপুর জেলার সকল ইউএনও , ইউপি চেয়ারম্যান একটি টিম হিসেবে কাজ করছে। এ কারণে ধারাবাহিকভাবে এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এ সাফল্য অর্জনে সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে রাজৈর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) উপমা ফারিসা বলেন, রাজৈরের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানবৃন্দ গ্রাম আদালত নিয়মিত পরিচালনা করছেন। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় তাদের প্রতি মাসের আদালত পরিচালনা যাতে আরো গতিশীল হয় সে ব্যাপারে আলোচনা করা হয়।এছাড়া গ্রাম আদালতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার জন্য যে কর্মকর্তা নিয়োগ করা আছে,তিনি নিয়মিতভাবে গ্রাম আদালত পরিচালনা সম্পর্কে চেয়ারম্যানদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা গ্রাম আদালতের কার্যক্রম নিয়ে খুবই সিরিয়াস।
এ ব্যাপারে শিবচর উপজেলা নিবার্হী অফিসার (ইউএনও) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, গ্রাম আদালত ব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণ ও বেগবান করার মাধ্যমে সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যায় বিচার পাবার সুযোগ অবারিত করেছেন। ছোট ছোট বিবাদ ও সামাজিক সমস্যার সমাধান গ্রাম আদালত এর মাধ্যমে সমাধান করার ফলে একদিকে মানুষ সুবিচার পাচ্ছেন, অপর দিকে বিচারিক আদালতে মামলার সংখ্যা বাড়ছে না । এটা সরকারের এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।
এ ব্যাপারে মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আল মামুন বলেন,
জনসাধরণ, বিশেষ করে নারী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে অন্যায়ের প্রতিকার দ্রুত ও অল্প খরচে সেবা প্রদানের জন্য মাদারীপুর সদর উপজেলায় প্রতিটি ইউনিয়নে আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিগত কয়েক মাসে জেলা প্রশাসক মহোদয় কর্তৃক নির্দেশিত বিশেষ কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম ত্বরাণিত হয়েছে। যার
ধারাবাহিকতায় ফেব্রুয়ারি ২০২৪ মাসে শতকরা হারে মাদারীপুর জেলার সর্বোচ্চ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
এ ব্যাপারে ডাসার উপজেলা নিবার্হী অফিসার (ইউএনও) কানিজ আফরোজ বলেন, মাদারীপুর জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশনা এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক স্যারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে গ্রাম আদালতের মামলা নিষ্পত্তিতে দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়েছে, একইসাথে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এবং সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরাও এ সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
এ ব্যাপারে কালকিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার
(ইউএনও) উত্তম কুমার দাস বলেন, গ্রাম আদালত পরিচালনায় সারা দেশে ফেব্রুয়ারি মাসে মাদারীপুর জেলা আবারও প্রথম হয়েছে । এ সাফল্যে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান স্যারের কার্যকর দিকনির্দেশনার জন্য হয়েছে । কালকিনিতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানবৃন্দ গ্রাম আদালত নিয়মিত পরিচালনা করছেন। আমরা গ্রাম আদালতের কার্যক্রম নিয়ে খুবই সিরিয়াস।
ডাসার উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দুলাল তালুকদার বলেন, বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালতে বিচারকার্য পরিচালিত হয়, গ্রাম আদালতে সাধারন মানুষ স্বল্প খরচে সঠিক বিচার পায়। সাধারণত গ্রাম আদালতে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য উভয়পক্ষের দুইজন করে সদস্য থাকে। বিচারক হিসাবে থাকেন ইউনিয়ন পরিষদের সন্মানিত চেয়ারম্যান। সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় ৩/২ অথবা ৪/১ হলেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আমি আমার ইউনিয়নে এখন পর্যন্ত ৪০ টির বেশি শালিস মিমাংসা করে দিয়েছি। সাধারন জনগণ এতে অনেক খুশি হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।
কালকিনি উপজেলার সাহেবরামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহিম বলেন, গ্রাম আদালতের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ের অভিযোগ গুলো মিমাংসা, নারী শিশু নির্যাতনের অভিযোগ সহ মহামান্য আদালত থেকে দেয়া কিছু মামলাও আমরা গ্রাম আদালতের মাধ্যমে আপস মিমাংসা করা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা ইউনিয়ন গ্রাম আদালতের মাধ্যমে ৭৫.০০০/ পচাত্তর হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারি।
শিবচর উপজেলা নিলখী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজান শিকদার বলেন, কম সময়ে, অল্প খরচে স্থানীয়ভাবে ছোট ছোট বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করা এবং সেই সাথে দরিদ্র, অনগ্রসর, নারী, সুবিধা বঞ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ন জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ও বিচার প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষে আমরা নিরলসভাবে কাজ করি। বিবদমান পক্ষসমূহের পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করি । স্থায়ীভাবে বিরোধ নিরসন করার চেষ্টা করি ও সেই সাথে উচ্চ আদালতে মামলার চাপ কমানো জন্য কাজ করি । সামাজিক ন্যায্যতা ও সুশাসন সৃষ্টি করাই আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের লক্ষ্য।
এ প্রসঙ্গে এক ইউপি চেয়ারম্যান মো. আসাদুজ্জামান খোকন বয়াতি বলেন, ডিসি স্যার ও ডিডিএলজি স্যারের উৎসাহ, গাইডলাইন ও সহায়তার ফলে আমরা সবাই নতুনভাবে কাজে ঝাপিয়ে পড়েছি।
এছাড়াও শিবচর, মাদারীপুর সদর, রাজৈর, কালকিনি ও ডাসার উপজেলার একাধিক বাদী ও বিবাদী সাথে কথা বলে জানা যায়, ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতের রায় তারা সন্তুষ্ট প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন আগে কোর্টে মামলা মোকদ্দমা করলে অনেক ঘোরাঘুরি করতে হতো, টাকা-পয়সা খরচ হতো, সময় ব্যয় হতো, এখন ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতের মাধ্যমে
আমরা খুব সহজে বিচার পাই, এতে আমাদের তেমন একটা সময় ব্যয় হয় না এবং তেমন টাকা- পয়সাও লাগে না।
মাদারীপুর এর সাফল্যগাথা অব্যাহত থাকুক এবং সমগ্র বাংলাদেশ গ্রাম আদালতের সুফল ভোগ করে সুখী, সমৃদ্ধ ও ন্যায়ভিত্তিক নাগরিক সমাজ গঠন করবে, এমন প্রত্যাশা করাই যায়।