নিউজ ডেস্ক : জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বদলে যাচ্ছে দেশের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা। সেই সাথে বদলে যাচ্ছে এক ঋতুর সঙ্গে আরেক ঋতুর তফাত।বদলে যাওয়া এই পরিস্থিতিতে বেড়েছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের আগ্রাসন।জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস ডেঙ্গু রোগের মৌসুম হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে সারা বছরজুড়েই ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমের আগেই হানা দেওয়া ডেঙ্গুর প্রকোপ যেন কমছেই না। চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা দেশের ইতিহাসে ইতোমধ্যে অতীতের সব বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটলেও যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়ায় ডেঙ্গু ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ইতোপূর্বে ডেঙ্গু রাজধানী কেন্দ্রিক থাকলেও বর্তমানে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।অতীতে শহরের বাসাবাড়িতে আবাসিক ধরনের মশা (এডিস ইজিপটাই) ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটালেও, বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের বুনো মশাও (এডিস এলবোপিকটাস) ডেঙ্গুর বাহক হিসেবে কাজ করছে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। ফলে শুধু শহর কেন্দ্রিক আবাসিক মশা নিধনের মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় বলেও তাদের মতামত।বছরব্যাপী ডেঙ্গুর সংক্রমণ বিষয়ে জানতে চাইলে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, দুটো কারণে মূলত ডেঙ্গু বছরব্যাপী সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। ২০১৯ সালের ডেঙ্গু মহামারিতে, ডেঙ্গু মশা ঢাকা মহানগর এবং বড় শহর থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এডিস মশার দুটো প্রজাতি ডেঙ্গুর বাহক। একটি হচ্ছে আবাসিক ধরনের ডেঙ্গু মশা, আরেকটি হচ্ছে বুনো ডেঙ্গু মশা।তিনি বলেন, সাধারণত স্বাভাবিক সময়ে শহরের আবাসিক মশাগুলোই ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে। কিন্তু সারা দেশে যখন মহামারির সময় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়লো, তখন বন্য মশাগুলোও এডিসের বাহকে রূপান্তরিত হয়। বন্য মশা ঝোপঝাড়, গাছের দুই ডালের মাঝে জমে থাকা পানিতে, গাছের ফাঁকফোকরে বা গর্তে, পাতায় জমে থাকা পানিতে বংশবিস্তার করে এবং এরা ঝোপঝাড়েই থাকে। শীতকালে শিশিরকণা বা কুয়াশা থেকে জমে থাকা পানিতেও এই বন্য ধরনের এডিস মশা ডিম পাড়তে এবং বংশবিস্তার করতে পারে। ফলে দেশের যেসব অঞ্চলে গাছপালা রয়েছে, সেখানেও বন্য এডিস মশা রয়েছে। এখন আর আবাসিক ধরনের এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বন্য ধরনের মশাও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেটি করার জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এসবের মধ্যে দিয়েই আমরা বুঝতে পারছি যে, এডিস মশার প্রজনন এখন সারা বছরব্যাপী হচ্ছে এবং ডেঙ্গুর সংক্রমণ সারা বছরব্যাপী তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার এ বিষয়ে বলেন, বছরব্যাপী ডেঙ্গুর পাদুর্ভাব থাকার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তন একটি কারণ। পাশাপাশি আরও দুটি কারণ রয়েছে। বাংলাদেশে এখন কিছু পার্মানেন্ট কন্টেইনার তৈরি হয়েছে। প্রচুর বহতল ভবন তৈরি হয়েছে। সারা বছরই এসব ভবনে গাড়ি ধোয়া হয়। এসব ভবনে সারা বছরেই আমরা ডেঙ্গু মশা পাচ্ছি। যার সাথে বৃষ্টির কোনো সম্পর্ক নাই। আবার কিছু কিছু স্থানে পানির সংকট রয়েছে। মানুষ ব্যবহারের জন্য পানি বিভিন্ন পাত্রে জমিয়ে রাখে। সেখানেও আমরা এডিস মশা পাচ্ছি। নির্মাণাধীন ভবনেও প্রচুর মশা আমরা পাচ্ছি। এই যে তিনটা মশার ব্রিডিং প্লেসের কথা বললাম, এগুলোর কার্যক্রম সারা বছরব্যাপী চলমান থাকে।তিনি আরও বলেন, আবার অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, ডেঙ্গু ভাইরাস বাহিত মশা শীত গ্রীষ্ম মানছে না, সারা বছরব্যাপী ডিম পাড়া এবং বংশবিস্তার করছে। এসব কারণেই দেশে এখন ডেঙ্গু সংক্রমণ সারা বছরব্যাপী চলছে।এ কীটতত্ত্ববিদ জানান, আবাসিক নয় বন্য মশা, যেগুলো গ্রাম্য এলাকা যেখানে বনাঞ্চল গাছপালা থাকে, সেই মশাগুলোও এডিসের বাহক হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে বলেই আমার মনে হয়। কিন্তু এটা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। তবে সন্দেহ হচ্ছে এই মশাটিও বর্তমানে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে।জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে সারা দেশে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ হচ্ছে এবং মৃত্যু বাড়ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে শহর থেকে গ্রামে সারা বছরব্যাপী মশা নিধনে দৃশ্যমান কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের চিকিৎসকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে এনে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা কমানো সম্ভব।