নিউজ ডেস্ক : রাজধানীর চাকচিক্যের ঠিক বিপরীতে যে কিছু অন্ধকার রয়েছে, সেটি দেখা যায় বিভিন্ন এলাকার বস্তির দিকে তাকালে। যেখানে বসবাস করে নিম্নবিত্তরা, তিল তিল করে গড়ে তোলে নিজেদের স্বপ্ন-সংসার।এসব স্বপ্নও আবার পুড়ে যায়, জ্বলে যায় আগুনের লেলিহান শিখায়।ঢাকার বস্তিগুলোয় আগুন লাগাটা যেন সাধারণ ঘটনা। কদিন পরপরই কোনো না কোনো বস্তিতে আগুন লাগে। মানুষ পোড়ে, পোড়ে তাদের আসবাব, অর্থ। কেউ মরে। কেউ আহত হয়। বারবার, প্রতিবার এমন ঘটনা দেখে দেশের মানুষ।আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস ইউনিট ও সদস্যরা আসবেন, আগুন নিয়ন্ত্রণ করবেন। ভুক্তভোগীদের উদ্ধার ও ক্ষতি যতটা সম্ভব কমানোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু রাজধানীতে তা হয় না। এর প্রথম ও প্রধান কারণ সরু রাস্তা। প্রতিকূলতা আছে আরও। কোথাও আগুন লাগলে অনেক মানুষই আছে প্রতিবেশীকে রক্ষায় তৎপর হয়ে ওঠেন। তারা চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদেরও বাধা হয়ে দাঁড়ায় উৎসুক জনতা, পানির উৎসের স্বল্পতা, রাস্তার যানজট ইত্যাদি।বস্তিগুলোয় আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের বরাবরের অভিযোগ, সরু রাস্তার কারণে সময়মতো পানিবাহী গাড়ি ঘটনাস্থলের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায় না। মূল মেশিন অনেক দূরে রেখে পাইপ টেনে পানি ছিটাতে হয়। এতেও অনেক সময় ব্যয় হয়। ফলে বস্তির লাগোয়া ঘরে আগুন লাগে। ছড়িয়ে পড়ে অন্যত্রও।সর্বশেষ সোমবার (১৩ মার্চ) রাতে রাজধানীর তেজগাঁও কুনিপাড়া বস্তিতে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে গিয়ে একই সমস্যায় ভুগেছে ফায়ার সার্ভিস। প্রত্যক্ষদর্শীদেরও দাবি তাই। সবার ভাষ্য, বস্তির প্রবেশপথও যদি অন্তত স্বাভাবিক থাকতো, হয়তো ক্ষয়ক্ষতি কমান যেত আরও। বস্তিতে আগুন মানেই সরু পথের চ্যালেঞ্জ।এদিন সন্ধ্যা ৭টা ৫২ মিনিটের দিকে কুনিপাড়া বস্তিতে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। মোট ১১টি ইউনিট সেখানে কাজ করে। রাত ১০টা ২০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুনের ঘটনায় নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীরও একটি দল। কিন্তু সরু পথ ও উৎসুক জনতার কারণে তাদেরও বেগ পোহাতে হয়েছে।মঙ্গলবার (১৪ মার্চ) সরেজমিনে কুনিপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বস্তির একটি অংশ পুরোটাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাড়াহুড়ো করে এক কাপড়ে বেরিয়ে যাওয়া বাসিন্দারা তাদের আবাসস্থলের আশপাশে ঘুরছেন। কেউ কেউ ধ্বংসস্তূপেই খুঁজে ফিরছেন তাদের আপন কিছু। বস্তিতে অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে তৈরি করা হয়েছিল টিনের তৈরি বহুতল ঘর। এখন ঘরগুলোয় ব্যবহৃত লোহা ও সিমেন্টে তৈরি কিছু খুঁটি ছাড়া আর কিছু নেই সেখানে।১৫ বছর আগে বরিশাল থেকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে কুনিপাড়া বস্তিতে এসে স্বামী-সন্তানসহ বসবাস শুরু রেহেনার। ১১ বছর ধরে বস্তিতে টেইলার্সের দোকান চালাতেন। কিন্তু গত সোমাবার কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার সব শেষ হয়ে যায়। মঙ্গলবার নিজের দোকানের স্থানে আসেন রেহানা। কাঁদতে কাঁদতে উল্টে-পাল্টে দেখছিলেন কিছু বেঁচেছে কিনা। সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটাবেন, তা নিয়ে ছিল তার উৎকণ্ঠা।রেহানা জানান, বস্তিতে বড় একটি রুম ভাড়া নিয়ে একাংশে স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস করছিলেন। বাকি অংশে টেইলার্সের দোকান চালাতেন। আগুনের খবর শুনে কোনোভাবে খর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সঙ্গে কিছু নিতে পারেননি। কয়েকঘণ্টার ব্যবধানে সব শেষ হয়ে যায় তার।বরিশাল বাকেরগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসা নুরুল ইসলামও ১ যুগের বেশি সময় ধরে কুনিপাড়া বস্তিতে বসবাস করছেন। পেশায় মিস্ত্রী নুরুল জানান, তিন হাজার টাকায় একটা রুম ভাড়া নিয়ে পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে বস্তিতে থাকতেন। সোমবার কাজ শেষে বস্তিতে ফেরার সময় আগুনের খবর পান। দৌড়ে বস্তিতে আসেন, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। আগুনের সময় স্ত্রী-সন্তান ঘরেই ছিল। তারা প্রাণে বাঁচলেও কিছু বাঁচাতে পারেননি।জানা গেছে, কুনিপাড়া বস্তির তিনটি অংশ। আগুনে স্থানীয় হালিম আহমেদের ৩৮, হেলাল উদ্দিন আহমেদের ৭৮ ও আক্কাস উদ্দিনের ২৫০টি ঘর পুড়ে গেছে। এসব ঘরের ভাড়া ছিল দুই থেকে ৪ হাজার।যে ঘরটি থেকে বস্তির আগুনের সূত্রপাত, সেটিতে ঘটনার সময় কেউ ছিল না। বস্তির উত্তরপাশে তালাবন্ধ ঘরটিতে আগুন দেখে জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেন বাসিন্দাদের কেউ।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বস্তির গলি খুবই সরু, এসব গলি দিয়ে ঠিকমতো রিকশা চলতে পারে না। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রথমে এসে ভেতরে ঢুকতে পারছিল না। এরমধ্যে স্থানীয় বাসিন্দারা যে যার মতো পানি ছিটানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছিল না। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে।আগুন নিয়ন্ত্রণের সময় থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন রোভার স্কাউট সদস্য মো. মুহিব্বুল্লাহ। তিনি বলেন, রাত ৮টার দিকে আগুনের খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে আসি। এসে দেখি বস্তির গলি দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারছে না। এরপর বস্তির একদিকে থাকা একটি ফ্যাক্টরির টিনের চাল বেয়ে উঠে আমরা ও ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করি।ফায়ার সার্ভিসের পানিবাহী গাড়িগুলোও কিছুটা পথ পানি নিয়ে ঢুকে আবার পানি আনতে ঘুরিয়ে যেতেও পারছিল না। পেছনের দিকে উল্টো একটি গাড়ি বের হওয়ার পর আরেকটি গাড়ি ঢুকতে হচ্ছিল। এমনকি অনেক দূর থেকে পাইপ টেনে পানি ছিটাতে হচ্ছিল বস্তিতে।তিনি বলেন, বস্তিতে কিছু পাকা বাড়ি ছিল, যেগুলোর আগুন তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। কিন্তু টিন-কাঠ দিয়ে ২-৩ তলা পর্যন্ত বাড়ি ছিল। এগুলো আগুনে একসময় ধসে পড়ে। আগুন আরও ছড়িয়ে যাওয়া ঠেকানোও একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। ধসে পড়া ঘরগুলোয় আজ সকালেও কোথাও কোথাও আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। আগুনের তাপে বিভিন্ন ঘরের কাঁচের আসবাবও প্লাস্টিকের মতো গলে গেছে, অর্থাৎ আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘরে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।ফায়ার সার্ভিসের তেজগাঁও স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দেওয়ান মোহাম্মদ রাজিব বলেন, আমরা আগুন নেভানোর পর দেখেছি বস্তিতে বড় বড় ১১টি ঘর ছিল। সবগুলো আধাপাকা তবে, তিন তলাবিশিষ্ট। এর ভেতরে আবার ছোট ছোট অনেকগুলো ঘর ছিল। আমাদের হিসেবে প্রায় ২০০ ঘর পুড়ে গেছে।ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক (ঢাকা) দিনমনি শর্মা বলেন, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকা হওয়া সত্ত্বেও এখন সেটি বাণিজ্যিক আর আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়েছে। বস্তিটিতে ঢোকার পথ মাত্র তিন ফুটের। আমরা কোনো দিক দিয়েই বস্তিতে ঢুকতে পারছিলাম না। পরে হাতিরঝিল সংলগ্ন এলাকা দিয়ে টিনসেড চালার উপরে উঠে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করি।চারদিক দিয়ে প্রাচীর বেষ্টিত বস্তির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, আগুন নেভাতে আমাদের ব্যাপক বেগ পেতে হয়েছে। আমরা এখনো আগুনের কারণ অনুসন্ধান করতে পারিনি। তদন্ত সাপেক্ষে আগুনের কারণ স্পষ্ট হওয়া যাবে।