মোস্তাকিম ফারুকী
জনঘনত্বের বিচারে ঢাকা শহর বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতি। এই শহরে ছোটখাটো পার্কগুলো ই দিয়েছে প্রাণের প্রশান্তি। কিন্তু সেই প্রশান্তি কেড়ে নেওয়ার জন্য পার্ক দখল করে বানানো হচ্ছে ফুড কোড এবং ব্যবসা কেন্দ্র। আমাদের জীবন এখন এপার্টমেন্টে বন্ধি হয়ে গেছে। এখন বাচ্চারা মুক্ত অক্সিজেন নিতে পারছেনা। পুরান ঢাকার মানুষের মুক্ত বাতাস গ্রহণের জন্য হলেও পার্ক রাখতে হবে। ভিক্টোরিয়া পার্ক শুধু পার্ক নই, এটি বাংলার ইতিহাস। এই ইতিহাস যে নষ্ট করতে চাই সে জাতীয় বেইমান বলে মন্তব্য করেছেন বাহাদুর শাহ পার্ক রক্ষা কমিটির নেতৃবৃন্দ।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাহাদুর শাহ পার্কে ‘ফুড ভ্যান’ নামের খাবার দোকান নির্মাণের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। ১৮৫৭ সালের ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্ক রক্ষায় জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) ঢাকা মহানগর কমিটি এই বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করেন। গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ঢাকা মহানগর কমিটির সহ-সভাপতি জয়নাল আবদীন-এর সভাপতিত্বে এবং দপ্তর সম্পাদক আতিকুল ইসলাম টিটুর পরিচালনায় এনডিএফ’র কেন্দ্রীয় কমিটি সাধারণ সম্পাদক, ব্রি. জেনারেল. (অব.) এম জাহাঙ্গীর হোসাইন বলেন, ‘ফুড ভ্যান’ প্রকল্প নামে পার্কের ভেতরে খাবারের দোকান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে ডিএসসিসি। এ জন্য তারা গত ৩ আগস্ট ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা দরে দরপত্র আহ্বান করে। দরপত্র পাওয়া কর্তৃপক্ষ পার্কের ভেতরে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করেছে। সিটি করপোরেশনের কি এতই অভাব যে পার্ক ইজারা দিয়ে তাদের টাকা নিতে হবে? সুস্থ মস্তিষ্ক এবং শারীরিকভাবে সতেজ থাকতে হলে নিয়মিত ব্যায়াম দরকার। আমরা ছোটবেলায় বিকালে মাঠে খেলতে যেতাম, সন্ধ্যায় পড়তে বসতাম। এখন আমাদের জীবন এপার্টমেন্টে বন্ধি হয়ে গেছে। এখন বাচ্চারা মুক্ত অক্সিজেন নিতে পারছেনা। এই এলাকার মানুষের মুক্ত বাতাস গ্রহণের জন্য হলেও পার্ক রাখতে হবে। ভিক্টোরিয়া পার্ক শুধু পার্ক নয়, এটি বাংলার ইতিহাস। এই ইতিহাস যে নষ্ট করতে চায় সে জাতীয় বেইমান। এই পার্কের আশেপাশে রয়েছে অনেক গুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী এখানে অবসর সময় কাটাতে পারে, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চা করতে পারে। কিন্তু এখানে খাবারের দোকান দিলে এটির পরিবেশ সম্পুর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যাবে। সিটি করপোরেশনের উদ্দেশ্য কি? তারা কি দেশের সাহিত্য সংস্কৃতি ধবংস করতে চায়? একটা দেশকে পঙ্গু করতে চাইলে প্রথমে সেদেশের তরুণ প্রজন্ম এবং তার শিক্ষা সংস্কৃতি ধ্বংস করতে হয়। সিটি করপোরেশন ও তাই করছে। এছাড়াও প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সাবেক এডিশনাল এটর্নী জেনারেল এডভোকেট মনসুর হাবীব, ধ্রবতারা সাংস্কৃতিক সংসদ এর সভাপতি শ্যামল ভৌমিক, বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আলম ভুঁইয়া, বাংলাদেশ ও এসকে গার্মেন্টস এন্ড টেক্সটাইল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ দত্ত, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আখতারুজ্জামান খান, বাহাদুর শাহ পার্ক সংরক্ষণ পরিষদ এর সদস্য এডভোকেট ইলিয়াস হোসেন,বাহাদুর শাহ পার্ক প্রাতঃভ্রমণকারী সমিতি
সভাপতি ছানাউল্লাহ হকসহ অনেক লেখক, কলামিস্ট, সুশীল সমাজ। বক্তারা আরও বলেন, বাহাদুর শাহ পার্ক শুধু পার্ক নয়। এটি ১৮৫৭ সালের ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর শহীদদের রক্তে রঞ্জিত এক ঐতিহাসিক স্থান। ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের দেশপ্রেমিক বীর সিপাহীদের ধরে এনে তৎকালীন আন্টাঘর ময়দান নামে পরিচিত জায়গায় জনগণকে ভয় দেখানোর জন্য নির্যাতন করে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত গাছের উপর ঝুলিয়ে রেখেছিল বর্বর ইংরেজরা। এই ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৮৫৮ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করে। রানীর শাসনভার গ্রহণ করার ঘোষণা এই ময়দানেই (পার্ক) করা হয় এবং এই ময়দানের নামকরণ করা হয় ভিক্টোরিয়া পার্ক। পরবর্তিতে ১৯৫৭ সালে ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধের ১০০ বছর পূর্তিতে যেসব বীরদের নৃশংসভাবে যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, সেই বীরদের স্মরণে তৈরি করা হয় স্মৃতি স্তম্ভ এবং এই পার্কের নামকরণ করা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। সেই ইতিহাসকে সংরক্ষণ না করে এবং নতুন প্রজন্মের মাঝে গৌরবোজ্জ্বল এই ইতিহাস না ছড়িয়ে ঐতিহাসিক সাহসী বীরদের ইতিহাস মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে। পার্কের অভ্যন্তরে ফুড ভ্যানসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের পাঁয়তারা চালাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। এই ধরণের অবিবেচনা প্রসূত, অযৌক্তিক, অপরিনামদর্শি গণবিরোধী সিদ্ধান্ত বন্ধের দাবিতে বাহাদুর শাহ পার্ক সংরক্ষণ পরিষদ, বাহাদুর শাহ পার্ক প্রাতঃভ্রমণকারী সংঘসহ বিভিন্ন সংগঠন ও এলাকাবাসীর অব্যাহত প্রতিবাদ থাকা সত্ত্বেও সিটি কর্পোরেশন জনমতকে উপেক্ষা করে তাদের খামখেয়ালী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অনড় রয়েছেন। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা মনে করি বাহাদুর শাহ পার্কের অভ্যন্তরে এই ধরণের বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের কোন যৌক্তিকতা নেই। এই ধরণের বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মিত হলে এই ঐতিহাসিক স্থানের শুধুমাত্র মর্যাদাই ক্ষুন্ন হবে না, একইসাথে অত্র এলাকার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রীসহ এলাকাবাসীর অবসর বিনোদন, অক্সিজেন গ্রহণ ও শরীর চর্চার একমাত্র স্থানটি বেদখল হয়ে যাবে। যা কোন বিবেকবান মানুষই মেনে নিতে পারে না। সমাবেশে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র-এর প্রতি উদ্দেশ্য করে বলেন নগর পিতার মতো মানুষের সামান্য অর্থের বিনিময়ে (সূত্র মতে বাৎসরিক প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা) অথবা কোন ধরণের স্বজনপ্রীতির দোষে দুষ্ট হয়ে জনস্বার্থ বিরোধী এই সর্বনাশা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে গণ শত্রুতে পরিণত হওয়া সাধারণ মানুষ কোন ভাবেই মেনে পারছে না। তাই আগামী ৭ দিনের মধ্যে পার্কের অভ্যন্তরে ফুড ভ্যানসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের জন্য যে লোহা ও কনক্রিটের কাঠামো তৈরি করা হয়েছে তা তুলে নিয়ে সাধারণ মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে পার্কে শরীর চর্চা সহ অবসর বিনোদন গ্রহণ করতে পারে তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্মৃতিস্তম্ভের গাঁয়ে “১৮৫৭ সালের শহীদদের স্মরণে” লেখাটি দৃশ্যায়িত করে পূর্ণলিখন করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে প্রকৃত ইতিহাস জানানোর স্বার্থে বাহাদুর শাহ পার্কের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সিটি করপোরেশন কর্তৃক জনসম্মুখে দৃশ্যমান জায়গায় টানাতে হবে। নগর জীবনের সাথে সম্পর্কিত দখলকৃত সকল পার্ক, পুকুর, খাল, বিল ও নদী দখলমুক্ত করে নগরবাসীর জন্য ব্যবহার উপযোগী করা এবং কোনরকম ফি ছাড়াই উন্মুক্ত রাখতে হবে। পার্কের ভেতরে দোকান দেওয়ার ব্যাপারে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, ‘আমরা প্রথমে বিষয়টি বুঝতে পারিনি। এখন ইজারাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষকে স্থায়ী স্থাপনা ভেঙে ফেলার জন্য বলেছি। তারা ভ্রাম্যমাণ খাবার দোকান করবে। এ জন্য একটি নকশা করে দেওয়া হয়েছে। দোকান পরিচালনার পাশাপাশি তাদের দায়িত্ব থাকবে পার্ক পরিষ্কার করা। পার্কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।’ পার্কের স্মৃতি রক্ষার জন্য নতুন কোন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে কি না? এব্যাপারে তিনি জানান শিগগিরই মিটিং করে এব্যাপারে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাব।