এছাড়া পুরুষ সেবাগ্রহীতার তুলনায় নারী সেবাগ্রহীতারা কোনো কোনো খাতে বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন (স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, অন্যান্য খাত)। কোনো কোনো সেবাখাতে নারীদের তুলনায় পুরুষ সেবাগ্রহীতারা বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন (শিক্ষা, ভূমি সেবা)। এছাড়া ৩৫ বছরের নিচের সেবাগ্রহীতাদের তুলনায় ৩৬ ও এর বেশি বয়সের সেবাগ্রহীতারা অপেক্ষাকৃত বেশি দুর্নীতির শিকার হয়।বুধবার (৩১ আগস্ট) রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।টিআইবি জানায়, ২০২১ সালে দেশের সেবাখাতে জাতীয় পর্যায়ে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার ৮৩০ দশমিক ১ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। এই ঘুষের পরিমাণ বাংলাদেশে জিডিপির শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। সেবাখাতে দুর্নীতি ২০২১ জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালে ১৭টি খাত বিবেচনায় সার্বিকভাবে ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত সাতটি খাত হচ্ছে: আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৭৪.৪%), পাসপোর্ট (৭০.৫%), বিআরটিএ (৬৮.৩%) বিচারিক সেবা (৫৬.৮%), স্বাস্থ্যসেবা (৪৮.৭%), স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান (৪৬.৬%) এবং ভূমি সেবা (৪৬.৩%)।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২১ সালে সার্বিকভাবে ঘুষের শিকার হওয়া খানার হার ৪০ দশমিক ১ শতাংশ। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঘুষ গ্রহণকারী তিনটি খাত হচ্ছে পাসপোর্ট, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও বিআরটিএ। জরিপে অন্তর্ভুক্ত ঘুষদাতা খানার ৭২.১% ঘুষ দেওয়ার কারণ হিসেবে ‘ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না’-এ কথা বলেছেন, অর্থাৎ ঘুষ আদায়ের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ অব্যাহত রয়েছে।
টিআইবির তথ্যমতে, ২০২১ সালে সার্বিকভাবে খানাপ্রতি গড়ে ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে এবং সর্বোচ্চ ঘুষ আদায়ের তিনটি খাত হল বীমা, বিচারিক ও গ্যাস সেবা।
সংস্থাটি জানায়, সার্বিকভাবে ২০১৭ সালের তুলনায় সেবাখাতে দুর্নীতির শিকার খানার হার বৃদ্ধি পেয়েছে (২০২১ সালে যেখানে দুর্নীতির শিকার খানার হার একই খাত বিবেচনায় পাওয়া গিয়েছে ৭০.৮%, ২০১৭ সালে এই হার ছিল ৬৬.৫%)। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থের হার কমেছে। কিন্তু ঘুষ আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে। অপরদিকে অন্যান্য অনিয়ম-দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে সেবাখাতে দুর্নীতি বেড়েছে। বিভিন্ন খাতে ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও কোনো কোনো সেবাখাতে তা পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় দুর্নীতি একই অবস্থায় রয়েছে (যেমন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, পাসপোর্ট, বিআরটিএ ইত্যাদি) এবং কিছু খাতে বৃদ্ধি পেয়েছে (স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, এনজিও, বীমা ইত্যাদি)। এছাড়া ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে কোনো কোনো খাতে ঘুষের শিকার খানার হার বেড়েছে (স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান) এবং কোনো কোনো খাতে কমেছে (কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা)।
টিআইবির প্রধান নির্বাহী ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যারা দুর্নীতি ও ঘুষের শিকার তারা সংশ্লিষ্ট বিভাগে অভিযোগ করেছে। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগের সংখ্যা কম।
দুর্নীতির বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশের পর এই প্রতিবেদনকে অসত্য বলে দাবি করে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এ বিষয়ে মন্তব্য চাইলে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা আশা করব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই প্রতিবেদনকে ইতিবাচকভাবে দেখবে। গুরুত্বপূর্ণভাবে দেখবে। ‘
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি করলে পার পাওয়া যায়, এই ভাবনা থেকেই দেশে দুর্নীতি বাড়ছে। ’
নীতি-নির্ধারণী এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য ১০ দফা সুপারিশ জানিয়েছে টিআইবি।
সুপারিশগুলো হলো-
বিভিন্ন সেবাখাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অবস্থান ও পরিচয় নির্বিশেষে আইনানুগভাবে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে; এক্ষেত্রে বিভাগীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
সেবাগ্রহীতার সঙ্গে সেবাদাতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হ্রাসে সকল সেবা ডিজিটালাইজ করতে হবে। সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে ‘ওয়ান স্টপ’ সার্ভিস চালু করতে হবে এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
সেবাপ্রদানকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সেবাপ্রদানকারীদের আচরণগত বিষয়গুলো জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রণয়ন ও কার্যকর করতে হবে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবাদানের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাগত মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়া বন্ধ করতে হবে। সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণশুনানির মতো জনগণের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সেবাখাতে নাগরিক সনদে সেবামূল্য সম্পর্কিত তথ্য হালনাগাদ করতে হবে এবং তা দৃষ্টিগোচর স্থানে স্থাপন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কার্যকর করতে হবে, যেখানে সাধারণ সেবাগ্রহীতার সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে।
সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নিরসন প্রক্রিয়া (জিআরএস) সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। যেসব খাতে জনবল, অবকাঠামো ও লজিস্টিকসের কারণে সেবাদান ব্যাহত হয় সেসব খাতে বিদ্যমান ঘাটতি দূর করতে হবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য সামাজিক আন্দোলনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সেবাখাতে নাগরিক সনদে সেবামূল্য সম্পর্কিত তথ্য হালনাগাদ করতে হবে এবং তা দৃষ্টিগোচর স্থানে স্থাপন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কার্যকর করতে হবে, যেখানে সাধারণ সেবাগ্রহীতার সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে।
সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নিরসন প্রক্রিয়া (জিআরএস) সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। যেসব খাতে জনবল, অবকাঠামো ও লজিস্টিকসের কারণে সেবাদান ব্যাহত হয় সেসব খাতে বিদ্যমান ঘাটতি দূর করতে হবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য সামাজিক আন্দোলনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে সকল পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও তার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।