নিউজ ডেস্ক : বিভক্তি এবং বাস্তবতা বিবর্জন দেশের বামপন্থীদের অগ্রগতির বড় প্রতিবন্ধকতা বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি, সংসদ সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি কমরেড রাশেদ খান মেনন। সম্প্রতি দেশের বাম আন্দোলনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট এ বাম নেতা এসব কথা বলেন।দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাম আন্দোলনের অগ্রগতির পথে কী কী প্রতিবন্ধকতা রয়েছে জানতে চাইলে রাশেদ খান মেনন বলেন, সব থেকে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে দেশের বাম আন্দোলনের বিভক্তির ধারা। বিভক্তির মধ্যে একটা বড় অংশ যারা বাস্তবতাকে দেখতে চান না। দেশের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ যেটা, সেটা হচ্ছে দেশে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদের ঘটছে। এটাকে তারা না দেখে বর্তমান সরকারের বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সন্দেহের অবকাশ নেই, এটা করার দরকার আছে। কিন্তু আমাদের যে মূল শত্রু, তাকে যদি বিবেচনায় না আনি, তাহলে দেশটাতো থাকবে না। তিনি আরও বলেন, বামপন্থীদের মধ্যে একটা বড় অংশ, এর সঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু অংশও আছে, তারা সরকারের চরম বিরোধিতার মধ্যে আছে। বাস্তবে তারা বিএনপির নির্বাচন বর্জনের যে দাবি, সেই দিকেই ঝুঁকে যাচ্ছে। সাইফুল হক জোনায়েদ সাকিসহ যুক্ত হয়েই গেছে বলা যায়। অন্যদিকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) যদিও যায়নি, মধ্যপন্থার কথা বলে, তারাও সেখানে চলে যাবে। আর আমাদের অবস্থা হয়েছে না ঘারকা না ঘাটকা। অর্থাৎ জোটে আছি, কিন্তু জোটের যে কার্যকারিতা তা নেই। যদিও প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি আমাদের সঙ্গে বৈঠকেই বলেছেন, জোটবন্ধভাবে নির্বাচন করবেন। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহীর কমিটির বৈঠকেও তিনি জোটবন্ধভাবে নির্বাচন করার কথা বলেছেন। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বলেন, আমার মনে হয়, জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে শুধু সিট পাওয়া বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে, দেশের সামনে যে সমস্যাগুলো রয়েছে, দেশে সাম্প্রদায়িকতার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। বাংলাদেশের রাস্তায় ঘুরলে, আপনি আফগানিস্তানে না বাংলাদেশে আছেন সেটা বোঝা যায় না। এখন আমি রাস্তায় শাড়ি পরা নারী দেখি না, জানি না নারীরা নিজেরাই নিজেদের অবরুদ্ধ করে ফেলছেন কিনা, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ সম্প্রতি আমরা আফগানিস্তানে ঘটতে দেখেছি। এটাতো আমাদের জন্য বড় একটা বিপদ। তার থেকে বড় বিপদ হচ্ছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিভক্তির কারণে নতুন প্রজন্ম আমাদের ইতিহাস, ভূগোল জানে না। তাজউদ্দিন আহমেদের ছেলে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছে, আমাদের পঞ্চম ষষ্ঠ শ্রেণির ছেলে মেয়েরা জানেই না, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কী ছিল। আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, সেটা বুঝতে হবে।দেশে চলমান সম্পদের বৈষম্য প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এ বাম নেতা আরও বলেন, বর্তমান সমাজে বৈষম্য চূড়ান্ত। মুষ্টিমেয় কিছু ধনিকগোষ্ঠি এবং আমলাদের হাতে সকল সম্পদ। পিকে হালদারের কথা সবাই বলছেন, পিকে হালদার কি এমনি হইছে? পিকে হালদারের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুরু অর্থমন্ত্রণালয় সবাই জড়িত। আমাদের প্রতিমন্ত্রী বলছেন, মানুষজন আনন্দে বাজার করছে। সালমান রহমান বলছে, দেশে কোনো বেকার নাই, অথচ আমার বাসায় কাজের জন্য চাকরির জন্য প্রতিদিন লোক আসছে। মন্ত্রীরা বলছেন, গ্রামের মানুষরাও এখন জিনস প্যান্ট পরে, হ্যাঁ পরে, তবে আগে লুঙ্গি পরা মানুষদের যে মর্যাদাবোধ ছিল, এখন জিনস প্যান্ট পরা লোকদের মধ্যে সেই মর্যাদাবোধ নেই। এখন তারা কিশোর গ্যাং এ যুক্ত হয়ে যাচ্ছে, তারা এখন বখে যাচ্ছে। আমার বয়স ৭৯ বছর, জানি না আর কত দিন বাঁচবো, আমি জানি না আমাদের সন্তানদের আমরা কোন বাংলাদেশে রেখে যাচ্ছি। সেই জন্যেই আমাদের দেশে, আমরা যদি বাম আন্দোলন শক্তিশালী করতে না পারি, এসব থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নাই।জাতীয় নির্বাচন আসন্ন, সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক কোনো দলের সঙ্গে কোনো ধরনের জোট করে তাহলে আপনাদের অবস্থান কী হবে?উত্তরে রাশেদ খান মেনন বলেন, আমি সোজা কথা বলি, ২০০৬ সালে খালেদা জিয়া আমলে নির্বাচনে প্রশ্নে আপনাদের মনে আছে, আমাদেরকে না জানিয়ে আওয়ামী লীগ সাইখুল হাদিসের সঙ্গে ৫ দফা চুক্তি করেছিল। আমরা তখন প্রকাশ্যে এর প্রতিবাদ করেছি। আমরা ১১ দলের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করেছি। তখন আমরা বলেছিলাম, আমরা সেখানে থাকবো না। আজকে যদি তারা (আওয়ামী লীগ) হেফাজতকে সঙ্গে নিতে চায়, নেবে। তাহলে আমরা নাহয় এমপি হলাম না, তাতে কী যায় আসে। আমি এমপি হিসেবে বহুদিন থেকেছি, না হয়েও বহুদিন থেকেছি। সুতরাং তাদেরকে নিয়ে কোনো ধরনের ঐক্য হবে না। শেখ হাসিনা তাদের সঙ্গে গোপনে কী সমঝোতা করবে, সেটা তাদের বিষয়, আমার না। কিন্তু ১৪ দলের যে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ভিত্তি, উন্নয়নের প্রশ্নে যে ২৩ দফা বক্তব্য রয়েছে, এরই ভিত্তিতে ২০০৮ সালের নির্বাচনের ইশতেহার রচিত হয়েছে, অথবা ভীষণ ২০২১ রচিত হয়েছে। তারা যদি এটা না মানে তাহলে নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়াল মারবে, আর আমরা নিশ্চয়ই সেই গাছের তলে পড়তে রাজি না।১১ দলীয় জোট ভেঙে যাওয়া নিয়ে তিনি বলেন, ১১ দলীয় জোট ভেঙে যায়নি, ওরাইতো ১৪ দলের মূল শক্তি ছিল, কিন্তু যখন আমরা ১৪ দলের ঐক্য করে ফেললাম, তখন সেই সময় কিছু দল আপত্তি তুলল, যেমন নির্মলদা, আ ফ ম মাহবুবুল আপত্তি করেছিলেন। এরপর সিপিবি এবং বাসদ নির্বাচনী ঐক্যের প্রশ্নে আপত্তি করল। আগেও আন্দোলনের বিষয়ে নানা প্রশ্ন ছিল, কিন্তু নির্বাচনের ঐক্যের বিষয়ে তারা আপত্তি করে জোট থেকে বেড়িয়ে গেল। তার ফলে এই জোট যে কার্যকর একটা জোট ছিল, তা আর কার্যকর থাকল না।