১৯৪৬ সালে গাফফার চৌধুরীর বাবার মৃত্যুর পর তাকে চলে আসতে হয় বরিশাল শহরে। ভর্তি হন আসমত আলী খান ইনস্টিটিউটে। সে সময় আর্থিক অনটনে পড়ে উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে তিনি কংগ্রেস নেতা দুর্গা মোহন সেন সম্পাদিত ‘কংগ্রেস হিতৈষী’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন।
১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় আবদুল গাফফার চৌধুরীর প্রথম গল্প ছাপা হয়। বরিশালের সন্তান শামসুদ্দীন আবুল কালামের লেখা তখন কলকাতার প্রধান পত্রিকাগুলোতে ছাপা হতো। ১৯৫০ সালেই গাফফার চৌধুরীর কর্মজীবন পরিপূর্ণভাবে শুরু হয়। এ সময়ে তিনি ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন গাফফার চৌধুরী। এ সময় তিনি ‘মাসিক নকীব’ পত্রিকারও সম্পাদনা করেন। একই বছর তিনি আবদুল কাদির সম্পাদিত ‘দিলরুবা’ পত্রিকারও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। ১৯৫৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন।
ওই বছরেই তিনি প্যারামাউন্ট প্রেসের সাহিত্য পত্রিকা ‘মেঘনা’র সম্পাদক হন। ১৯৫৮ সালে আবদুল গাফফার চৌধুরী দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার রাজনৈতিক পত্রিকা ‘চাবুকে’র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। কিন্তু কিছুদিন পর সামরিক শাসন চালু হলে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর তিনি মওলানা আকরম খাঁ’র ‘দৈনিক আজাদ’-এ সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। এ সময়ে তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদীর’ স্বল্পকালীন সম্পাদক হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি দৈনিক ‘জেহাদ’-এ বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’র সম্পাদক হন।
পরের বছর ১৯৬৪ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নামেন গাফফার। ‘অণুপম মুদ্রণ’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দুবছর পরই আবার ফিরে আসেন সাংবাদিকতা পেশায়। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে ‘দৈনিক আওয়াজ’ বের করেন। সেটা বছর দুয়েক চলেছিল। ১৯৬৭ সালে আবার তিনি ‘দৈনিক আজাদ’-এ ফিরে যান সহকারী সম্পাদক হিসেবে।
১৯৬৯ সালে পত্রিকাটির মালিকানা নিয়ে সহিংস বিবাদ শুরু হলে তিনি আবার যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। ১৯৬৯ সালের পয়লা জানুয়ারি ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া মারা যান। সে বছররের আগস্টে হামিদুল হক চৌধুরীর অবজারভার গ্রুপের দৈনিক ‘পূর্বদেশ’-এ যোগ দেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘জয়বাংলা’য় লেখালেখি করেন। এসময় তিনি কলকাতায় ‘দৈনিক আনন্দবাজার’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ‘দৈনিক জনপদ’ বের করেন এ বরেণ্য সাংবাদিক। ১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে ৭২ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যান। দেশে ফেরার পর তার স্ত্রী গুরুতর রোগে আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে সুস্থ না হওয়ায় তাকে নিয়ে ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান।
এরপর আবদুল গাফফার চৌধুরীর প্রবাস জীবনের ইতিহাস শুরু হয়। বিলেত যাওয়ার পর প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন গ্রোসারি দোকানে কাজ করেন। এরপর ১৯৭৬ সালে তিনি ‘বাংলার ডাক’ নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ‘সাপ্তাহিক জাগরণ’ পত্রিকায়ও তিনি কিছুদিন কাজ করেছেন।
১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সাতজন অংশীদার নিয়ে ‘নতুন দিন’ পত্রিকা বের করেন। এরপর ১৯৯০ সালে ‘নতুন দেশ’ এবং ১৯৯১ সালে ‘পূর্বদেশ’ বের করেন। প্রবাসে বসেও তিনি বাংলাদেশের প্রধান পত্রিকাগুলোয় নিয়মিত লেখালেখি করতেন।
বাংলাদেশের শীর্ষ দৈনিকগুলোয় প্রকাশিত আবদুল গাফফার চৌধুরীর রাজনীতি, সমসাময়িক ঘটনা ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী নিয়ে লেখা কলাম অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাংলাদেশে তিনি আওয়ামী লীগ পন্থী কলামিস্ট হিসাবে পরিচিত এবং সমালোচিত। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ প্রচারক হিসাবে তিনি রাজনৈতিক বিষয়াবলী ব্যাখ্যা করতেন।
তার লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান (১৯৬০), নাম না জানা ভোর (১৯৬২), নীল যমুনা (১৯৬৪), শেষ রজনীর চাঁদ (১৯৬৭)।
জীবদ্দশায় বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৭), একুশে পদক, ইউনেস্কো পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার ভূষিত হন এ লেখক। এ ছাড়া সংহতি আজীবন সম্মাননা পদক-২০০৮ (লন্ডন), স্বাধীনতা পদক ২০০৯, মানিক মিয়া পদক ২০০৯, যুক্তরাজ্যের ফ্রিডম অব বারা (টাওয়ার হ্যামলেটস) উপাধি, সংহতি আয়োজিত প্রবাসীদের পক্ষ থেকে সংবধর্না (ঢাকা ২০০৯) পেয়েছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী।
বৃহস্পতিবার (১৯ মে) যুক্তরাজ্যের লন্ডনের স্থানীয় সময় ভোরে হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান আবদুল গাফফার চৌধুরী। তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী-স্পিকারসহ আওয়ামীলীগের বিভিন্ন মন্ত্রী, নেতাকর্মীরা শোক প্রকাশ করেছেন। মৃত্যুর সময় বরেণ্য এ সাংবাদিকের বয়স হয়েছিল ৮৬।