কমান্ডার ইন চিফ বা সর্বোচ্চ অধিনায়ক হিসেবে যেকোনো ধরনের যুদ্ধাভিযানের চূড়ান্ত দায়িত্ব তার ওপরেই বর্তায়। তবে পুতিন এ ক্ষেত্রে সবসময় তার অত্যন্ত অনুগত কিছু লোকজনের ওপর নির্ভর করেন, যাদের মধ্যে অনেকেই রাশিয়ার নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মজীবন শুরু করেছিলেন।
প্রেসিডেন্টের মেয়াদকালের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলোতে কারা পুতিনকে পরামর্শ দেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সের্গেই শোইগু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী
পুতিনের দীর্ঘদিনের আস্থাভাজন সের্গেই শোইগু, যিনি ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণ এবং পশ্চিমাদের তথাকথিত সামরিক হুমকি থেকে রাশিয়াকে রক্ষা করার জন্য এই লড়াই দরকার বলে পুতিনের কথারই পুনরাবৃত্তি করে গেছেন।
তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনের এতটাই ঘনিষ্ঠ যে, তার সঙ্গে শিকার করতে এবং মাছ ধরতে সঙ্গী হিসেবে সাইবেরিয়ায় যান এবং তাকে একসময় পুতিনের সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে দেখা হয়েছিল।
সমর বিশেষজ্ঞ ভেরা মিরোনোভা বলেন, ২০১৪ সালে সামরিক অভিযান চালিয়ে ক্রিমিয়া দখলের সাফল্যের কৃতিত্ব তাকে দেওয়া হয়। তিনি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউর দায়িত্বেও ছিলেন। নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগ করে বিষক্রিয়ার দুটি ঘটনার জন্যও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। যুক্তরাজ্যের সলসবারিতে ২০১৮ সালের ভয়াবহ হামলা এবং ২০২০ সালে সাইবেরিয়ায় বিরোধী নেতা অ্যালেক্স নাভালনির ওপর প্রায় প্রাণঘাতী হামলার পেছনেও ছিল তার নাম।
তিনি বলেন, শোইগু শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীর দায়িত্বে নন, তিনি আংশিকভাবে মতাদর্শের দায়িত্বেও রয়েছেন। রাশিয়ায় মতাদর্শ মানে মূলত দেশটির ইতিহাস এবং তিনি এই ইতিহাসের বয়ানটা ঠিক কী হবে, সেটি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন। যদিও চিফ অফ স্টাফ হিসেবে ইউক্রেন আক্রমণ করা এবং দ্রুত কাজটি সম্পন্ন করা তার কাজ হলেও সেই দায়িত্ব তিনি ঠিকমত পালন করতে পারেননি।
১৯৯৯ সালের চেচেন যুদ্ধে সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়ার পর থেকেই তিনি ভ্লাদিমির পুতিনের সামরিক অভিযানে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছেন। তিনি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান পরিকল্পনায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় ছিলেন। গত মাসে বেলারুসে সামরিক মহড়ার তত্ত্বাবধানেও ছিলেন তিনি।
জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভও, রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ
রাশিয়া বিশেষজ্ঞ মার্ক গ্যালিওত্তি তাকে ‘রাশভারী, মারকুটে’ স্বভাবের বলে বর্ণনা করেছেন। জেনারেল গেরাসিমভও ক্রিমিয়া দখলের সামরিক অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
কোনো কোনো খবরে বলা হচ্ছে, ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুতেই যেভাবে হোঁচট খেয়েছে এবং সৈন্যদের মনোবল যেভাবে দমে গেছে, সেকারণে তাকে মূল দায়িত্ব থেকে কিছুটা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু আন্দ্রেই সোলদাটভ মনে করেন, যারা এরকম কিছু দেখতে চান, এটা তাদের কথা। পুতিনের একার পক্ষে তো প্রতিটি রাস্তা এবং প্রতিটি ব্যাটালিয়ন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় এবং জেনারেল গেরাসিমভ সেই ভূমিকাটি পালন করেন।
আন্দ্রেই সোলদাটভ বলেন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়তো সামরিক ইউনিফর্ম পরতে পছন্দ করেন, কিন্তু তার আসলে কোনো সামরিক প্রশিক্ষণ নেই। এজন্য তাকে পেশাদার সেনা অফিসারদের ওপর নির্ভর করতে হয়।
নিকোলাই পাক্রশেভ, নিরাপত্তা পরিষদের সচিব
তিনি পুতিনের তিন বিশ্বস্ত মানুষের একজন, যারা ১৯৭০ এর দশকে সেন্ট পিটার্সবার্গের সময় থেকে তার সঙ্গে কাজ করেছেন, যখন রাশিয়ার এই দ্বিতীয় শহরটি লেনিনগ্রাদ নামে পরিচিত ছিল।
অন্য দুই নেতা হলেন সিকিউরিটি সার্ভিসের প্রধান আলেকজান্ডার বোর্টনিকভ এবং বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান সের্গেই নারিশকিন। প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বৃত্তের ভেতরে থাকা সবাই সিলোভিকি বা বাস্তবায়নকারী হিসেবে পরিচিত, তবে এই তিনজন আরও বেশি ঘনিষ্ঠ।
প্রেসিডেন্টের ওপর নিকোলাই পাত্রুশেভের মতো প্রভাব খুব কম মানুষই রাখেন। তিনি কমিউনিস্ট যুগে তার সঙ্গে তৎকালীন কেজিবিতে কাজ করেছিলেন। পরে ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নতুন সংস্থা এফএসবি’র প্রধান হিসেবে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আলেকজান্ডার বোর্টনিকভ, ফেডারেল নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক
ক্রেমলিনের পর্যবেক্ষকরা বলেছেন যে, প্রেসিডেন্ট অন্য যেকোনো উৎসের চেয়ে সিকিউরিটি সার্ভিস থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর বেশি বিশ্বাস করেন এবং আলেকজান্ডার বোর্টনিকভকে পুতিনের অভ্যন্তরীণ বৃত্তের অংশ হিসেবে দেখা হয়।
তিনি লেনিনগ্রাদ কেজিবি থেকে আসা আরেক পুরোনো কর্মকর্তা। নিকোলাই পাত্রুশেভ এফএসবি থেকে সরে যাওয়ার পর তিনি এর স্থলাভিষিক্ত হয়ে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
সের্গেই নারিশকিন, ফরেন ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের পরিচালক
সের্গেই নারিশকিন বহু দশক ধরে প্রেসিডেন্ট পুতিনের ছায়াসঙ্গী। ১৯৯০-এর দশকে সেন্ট পিটার্সবার্গে, তারপর ২০০৪ সালে পুতিনের অফিসে এবং অবশেষে পার্লামেন্টের স্পিকার হিসেবে।
পুরোনো লেনিনগ্রাদের ওই তিনজনের বাইরে, সের্গেই নারিশকিন তার ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় প্রেসিডেন্টের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু রাশিয়ার নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক চলাকালে যখন তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছিলেন, তখন পুতিন তাকে যেভাবে অপদস্ত করেন, সেটার তাহলে কী অর্থ?
প্রেসিডেন্ট পুতিন যখন পরিস্থিতি সম্পর্কে তার মূল্যায়নের কথা জানতে চাইলেন, গোয়েন্দা প্রধান তখন আমতা আমতা করছিলেন। তখন প্রেসিডেন্ট তাকে এই বলে ধমকে দেন যে ‘এখানে আমরা তো ওই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি না’।
সের্গেই ল্যাভরভ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
টানা ১৮ বছর ধরে তিনি রাশিয়ার শীর্ষ কূটনীতিক, তিনি রাশিয়াকে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করেছেন। যদিও যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তার বড় কোনো ভূমিকা নেই।
ভ্লাদিমির পুতিন যে তার অতীতের লোকদের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করেন, ৭১ বছর বয়সী সের্গেই ল্যাভরভ তার আরেকটি উদাহারণ।
গত মাসে তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাসকে তার রাশিয়ার ভূগোল জ্ঞান নিয়ে উপহাস করেছিলেন। এক বছর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান জোসেপ বোরেলকেও অপমান করার চেষ্টা করেন।
ভ্যালেন্টিনা মাতভিয়েনকো, ফেডারেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান
পুতিনের ঘনিষ্ঠ মহলের মধ্যে তিনি এক বিরল নারী চরিত্র। রাশিয়ার পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে বিদেশে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়েছে তার সভাপতিত্বে। আর এর মাধ্যমেই ইউক্রেনে সেনা অভিযানের পথ খুলে গেছে।
ভ্যালেন্টিনা মাতভিয়েনকো হলেন সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে আসা পুতিনের বিশ্বস্ত এবং অনুগত ব্যক্তিদের আরেকজন। তিনি ২০১৪ সালেও ক্রাইমিয়াকে দখল করার প্রচেষ্টায় সাহায্য করেছিলেন।
ভিক্টর জোলোতভ, ন্যাশনাল গার্ডের পরিচালক
তিনি প্রেসিডেন্টের একজন প্রাক্তন দেহরক্ষী। এখন রাশিয়ার ন্যাশনাল গার্ড, রোসগভার্ডিয়া পরিচালনার দায়িত্বে আছেন।
রোমান সাম্রাজ্যের প্রাইটোরিয়ান গার্ডের আদলে এটি মাত্র ছয় বছর আগে গঠন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন, যা অনেকটা তার ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী হিসাবে কাজ করবে।
প্রেসিডেন্ট পুতিন নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষীকে এই বাহিনীর প্রধান হিসেবে বেছে নিয়েছেন, যাতে এটি সবসময় তার প্রতি অনুগত থাকে। ভিক্টর জোলোটোভ এরই মধ্যে এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা চার লাখে উন্নীত করেছেন।
পুতিন আর কার কথা শোনেন?
প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্টিন রাশিয়ার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কঠিন কাজের দায়িত্বে। তবে যুদ্ধের বিষয়ে তার তেমন কিছু বলার নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইয়েভজেনি মিনচেনকোর মতে, মস্কোর মেয়র সের্গেই সোবিয়ানিন এবং রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি রোসনেফ্টের প্রধান, ইগর সেচিনও প্রেসিডেন্টের বেশ ঘনিষ্ঠ।
ধনী ব্যবসায়ী দুই ভাই বরিস এবং আর্কাডি রোটেনবার্গ, প্রেসিডেন্টের শৈশবের বন্ধু ছিলেন, তারাও দীর্ঘকাল ধরে তার ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজন হিসেবে আছেন। ২০২০ সালে, ফোর্বস ম্যাগাজিন তাদের রাশিয়ার সবচেয়ে ধনী পরিবার হিসাবে তালিকাভুক্ত করে।