বিআরটিএর হিসাবে, প্রতিবছরই চট্টগ্রামে মোটরসাইকেল নিবন্ধনের হার বাড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নিবন্ধনের সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৫৭৩টি। আর এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে ১ লাখের বেশি মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা গবেষকেরা বলেছেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো মূলত ঘটে বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, বারবার লেন পরিবর্তন, ট্রাফিক আইন না মানা ও চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোনে কথা বলার কারণে। হেলমেট ব্যবহার না করা ও নিম্নমানের হেলমেটের কারণে দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় অর্ধেকই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। গত বছরে চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা হয়েছে ১৬.২৪ শতাংশ ও নিহত হয়েছে ১৭.৭৩ শতাংশ। ভোরে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪.৫১ শতাংশ, সকালে ৩১.৩৫ শতাংশ, দুপুরে ১৮.৭৮ শতাংশ, বিকেলে ২০.৩৩ শতাংশ, সন্ধ্যায় ৬.০৭ শতাংশ এবং রাতে ১৮.৯২ শতাংশ।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, ২০২১ সালে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ও শূন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে হয়েছে। বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ দুর্ঘটনার কারণ। এছাড়া ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চালাচ্ছে লাইসেন্সবিহীন চালকরা। নগরের বিভিন্ন সড়কে ১৪-১৫ বছর বয়সী কিশোররাও গাড়ি চালাচ্ছে। হিউম্যান হলার ও টেম্পোতে কমবয়সী চালকের সংখ্যা বেশি।
চসিক মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী জানিয়েছিলেন, নগরে লাইসেন্সধারী রিকশার সংখ্যা ৩৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ভবিষ্যতে দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি দেওয়া হবে ডিজিটাল লাইসেন্স প্লেট, চালকের থাকবে স্মার্ট আইডি। কিন্তু গত এক বছরে অবৈধ রিকশা বেড়েছে, মিলেনি চালকদের আইডি।ট্রাফিক সার্জেন্টরা জানান, বড় গাড়ির তুলনায় নগরে ছোট গাড়িগুলো অনিয়ম বেশি করে। তাই সেসব গাড়ির বিরুদ্ধে মামলাও হয় বেশি। অধিকাংশ চালক লেন মেনে গাড়ি চালান না। অনেক সময় অপ্রয়োজনীয়ভাবে লেনও পরিবর্তন করেন। সুযোগ পেলেই ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করার চেষ্টা করেন। উল্টো পথ দিয়ে আসেন। ছোটখাটো দুর্ঘটনা হলে রাস্তার মাঝখানে তর্ক করে যানজট সৃষ্টি করা এখন প্রতিদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইন ভঙ্গের জন্য মামলা বা ব্যবস্থা নেওয়ার সময় তারা নানা রকম তদবিরের চেষ্টা করেন।নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক শফিক আহমেদ সাজীব বলেন, এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন র্যাডিসন ব্লু হোটেলের সামনে ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে অটোরিকশার ধাক্কায় রিকশা থেকে ছিটকে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন ডা. সামিনা। ভিডিও ফুটেজ দেখে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, অটোরিকশাটি চলছিল দ্রুতগতিতে এবং রিকশাচালক অপর পাশ থেকে সড়কের মাঝখানে চলে এসেছিল। ১৯ বছরের মো. হৃদয়কে দারিদ্রতা বাধ্য করেছে রিকশা চালাতে। এমন অদক্ষ চালকদের জন্য সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। স্বজন হারানোর কষ্ট আজীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে পরিবারকে। তিনি বলেন, সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের ঘোষণা দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। উল্টো মালিক-শ্রমিকদের আইনের ৩৪টি ধারা সংশোধনের প্রস্তাবের মধ্যে ২৯টি আমলে নিয়ে সংশোধনের সুপারিশ করেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গঠিত কমিটিও কিছু নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও কোনও অগ্রগতি দেখা যায়নি।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ‘আমার গাড়ি নিরাপদ’ কর্মসূচির আওতায় ১৭ হাজার ৫৫০টি সিএনজি অটোরিকশার মালিক-চালককে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এনেছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৮৬২ জন মালিক ও ১২ হাজার ৬৮৮ জন চালক।সিএমপি ট্রাফিক (উত্তর) বিভাগের উপ কমিশনার জয়নুল আবেদীন বলেন, ইতিমধ্যে ১ হাজার ৮৫০ জন মালিককে কিউআর কোড সম্বলিত স্টিকার ও ৬শ জন চালককে কিউআর কোড সম্বলিত আইডি কার্ড দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক দিন ধারাবাহিকভাবে মালিকের কিউআর কোড সম্বলিত স্টিকারগুলো সিএনজি অটোরিকশায় লাগানো ও চালকদের বিতরণ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নিয়মিত পথচারী ও চালকদের সচেতন করা হচ্ছে। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলে ‘ই-ট্রাফিক প্রসিকিউশন সিস্টেম’ অনলাইন সেবার মাধ্যমে গ্রাহকরা অল্প সময়ের মধ্যে এমনকি উপস্থিত স্থানেই মামলার জরিমানা পরিশোধ করে খুব সহজেই মামলাটি তুলে নিতে পারছেন। মোবাইলে ইউ ক্যাশ এর মাধ্যমেও জরিমানা পরিশোধ করতে পারছেন।