সাধন চন্দ্র মণ্ডল : একটা শিশু জন্মের পর প্রথম সান্নিধ্য পায় তার মা ও বাবার। চৈতন্য প্রাপ্তির পূর্বে কান্নাই তার অভাবের প্রথম প্রকাশ। এরপর নানাভাবে সে তার অভাব জানান দেয়। আকার ইঙ্গিত বা সংকেতে বুঝাতে ব্যর্থ হলে মোক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করে যা হলো কান্না। শিশু কাঁদলে মা অস্থির হয়ে পড়েন আর বাবাও সুস্থির থাকতে পারেন না। উতলা হয়ে পড়েন নিকট জনেরা। ধীরে ধীরে জানার পরিধি বাড়তে থাকে। একসময় কথা ফোটে শিশুর, তখন মা-বাবার খুশির অন্ত থাকে না। সন্দেহাতীতভাবে সত্য যে, শিশুর মুখে ম..মা..শব্দটিই আগে শোনা যায়। প্রতিটি মানুষেরই শিশুকাল রয়েছে, রয়েছে জানা অজানা অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অনেকেই বড় হওয়ার পর সে সব আর মনে রাখতে চায় না । আবার মনে রাখার তেমন প্রয়োজনও পড়ে না। কেননা জীবন সম্মুখপানে ধাববান। তবুও একজন পরিনত ব্যক্তি যদি তাঁর স্মৃতির আতুড় ঘর অনুসন্ধান করতে চায় তবে বাস্তবতা বিবেচনায় এক কল্পিত জীবনকাল উপলব্ধি করতে পারে। যদিও তা সত্য সংকটে থাকে তথাপিও তাকে সত্য ভ্রষ্ট বলা যাবে না বরং সত্যের কাছাকাছি বলতে পারি। যাহোক প্রত্যেকের কাছে তার পরম গুরু হলো মা-বাবা। মা-বাবার কাছ থেকে তার প্রাথমিক শিক্ষাসহ তাঁদের জীবনকাল অবধি নিঃস্বার্থ উপদেশ চলমান থাকে। তবে একটা নির্দিষ্ট সময় পরে মা-বাবাই তাঁদের আদরের সন্তানকে শিক্ষককের হাতে তুলে দেন পরম নির্ভরতায়। আশা তাঁদের সন্তানকে প্রাতিষ্ঠানিক বা ফরমাল শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে। এজন্য শিক্ষকের প্রতি শুধু ছাত্রের আনুগত্য বা সম্মান থাকে না বরং মা-বাবারও কৃতজ্ঞতার সীমা থাকে না। এক অকুন্ঠ ঋণে আবদ্ধ হয়ে পড়েন যা অমোচনীয় ও অপরিশোধ্য মনে করেন সারা জীবন। সন্তানের সাফল্যের কৃতিত্বের সবটুকুই তাঁরা শিক্ষককেই দিতে চান। তাই তো সঙ্গতি অনুযায়ী সর্বোচ্চ সমর্পন করতে চায় শিক্ষকদেরকে পরিতৃপ্তির জন্য। বাড়ির ভাল জিনিসটা শিক্ষকের বাসায় দিতে চান। অনেকে স্কুলের সকল শিক্ষক ও স্টাফদেরকে বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে আপ্যায়ন করান। এই মধুর সম্পর্ক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি যতটা প্রগাঢ় থাকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একটু শিথিল হয় আর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি মা-বাবার সম্পর্ক ক্ষীণ হলেও ছাত্রের জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে সম্পর্ক প্রকট হয়ে ওঠে।
আজ থেকে চৌত্রিশ বছর আগে আমার ব্যাংকিং কর্মজীবনে প্রথম একটা শাখার দায়িত্বভার গ্রহণ করি, তখন অঞ্চল প্রধান স্যারের কথাকে অনুসরণীয় বাণী বলে বিশ্বাস করতাম এবং মানতামও। সহিদুর রহমান স্যার শুধু ব্যাংকিং পরামর্শ দিতেন না বাস্তব অনেক শিক্ষামূলক ঘটনাও বলতেন। তাঁর একটা কথা আজ খুবই বেশি করে সনে পড়ছে। স্যারের নিজের জবানীতে ঘটনাটির বর্ণনা ছিল এরকম,“আমরা যখন দৌলতপুর বি. এল. কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ি তখন লঞ্চে কলেজে যেতাম। একদিন অযৌক্তিকভাবে বেশি ভাড়া দাবী করলে কলেজ ছাত্রদের সাথে লঞ্চের সুপারভাইজারের কথা কাটাকাটি হয়। কলেজ ছাত্ররা লঞ্চ থেকে নামার সময় লঞ্চটিকে আটক করে। আটক করার তেমন কিছু না পাওয়ায় লঞ্চের দড়ি দিয়ে বাশের লগির সাথে বেঁধে রাখা হয়। এই হলো আটক। ঘাটে একটা সাড়া পড়ে গেল কলেজ ছাত্ররা লঞ্চ আটক করেছে। লঞ্চের স্টাফরা মালিককে খবর দিল। মালিক বললো ছাত্ররা কখন ফিরবে অপেক্ষা করো এবং তখন আমাকে খবর দিও। আমরা বিকাল ৪ টার সময় ফিরে এসে দেখি লঞ্চটা একইভাবে বাঁধা আছে। সকালের ঘটনা আমরা ভুলে গেছি কিন্তু কলেজ ছাত্রদের যে সম্মান দিয়েছেন মালিক ও ষ্টাফরা আমাদের নিজেদেরকে অপরাধী মনে হচ্ছে। মালিক স্টাফদের ভর্ৎসনা করলেন। কিন্তু আমরা থামিয়ে দিলাম এবং বললাম আপনারা আমাদের মুরব্বী আমাদের লেখাপড়ার জন্য আপনাদের অবদান কম নয় আমরা চিরজীবন মনে রাখবো। আমাদের ব্যবহারে কষ্ট পেলে ক্ষমা করে দিবেন। মালিক আমাদেরকে জড়িয়ে ধরে আর্শিবাদ করলেন। আজ সে স্মৃতি মনে হলে অবাক লাগে কিন্তু এটা বুঝি, যে আমার পিতা নয় তারও সন্তান আছে তাই সম্মান দিলে দোষ কি? বরং তাঁর পিতৃহৃদয়ের অমৃত আশীষ পেতে পারি।”
ছাত্র- শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি একদিনে হয়নি। এ অবক্ষয় দীর্ঘদিনের, তিলে তিলে দিনের পর দিন অবক্ষয়ের চরম সীমায় অবনীত। এটাকে সামাজিক অবক্ষয় বলতে হবে। এককভাবে কাউকে দায়ী করা ঠিক হবে না। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক যেমন দায়ী তেমনি সামাজিক অনুশাসন, সমাজ নিয়ন্ত্রক ও রাজনীতিবিদ কেউই দায় এড়াতে পারেন না। আমাদের ছোটকালে যে শিক্ষা পেয়েছি তা এখন চলবে না যেমন শিক্ষকের ভুল সরাসরি বলা যাবে না পরে একান্তে বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ করতে হবে। কিন্তু আজ বিশ্বায়নের যুগে তথ্য হাতের নাগালে থাকে তাই এখনকার ছাত্ররা সরাসরি বলতে চায়। আবার শিক্ষকদের মধ্যেও ইগো কাজ করে তারাও ছাত্রদের নানাভাবে মানসিক পীড়ন দিয়ে তৃপ্তি পায় এটা কখনো কাম্য হতে পারে না। যে শিক্ষা মানুষকে সহজ না করে, বিনয় আনে না, উদার করে না সে শিক্ষা বৃথা। শিক্ষা মানুষের চলায় বলায় ও আচরণে প্রতিফলিত হবে।
একজন ছাত্র তার কমনীয়তা, লাবণ্য ও সরলতার দীপ্তি হারিয়েছে। কোন প্রবীন ব্যক্তি তার আচরণে তাকে আদর করার ইচ্ছা জাগ্রত করে না বরং পাশ কাটিয়ে যেতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের মানসিকতা এখন আর শিক্ষা সামগ্রী নিয়ে ভাববার সময় নেই তাদের মনে এখন মিলিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন খেলা করে, তাঁদের স্বপ্ন এখন কিভাবে অর্থ আহরণ করা যায় যাতে পরবর্তী জীবন নিশ্চিন্ত থাকা য়ায়। নীতি নৈতিকতা বা আদর্শ সব বোকা বোকা লাগে। শিক্ষকও তাঁর ছাত্রদের প্রতি নিঃস্বার্থ নিবেদিত নয়। যে আদর্শ নিয়ে আগে সর্বোচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি শিক্ষকতায় আসতেন এখন তা বিরল। শিক্ষাটা এখন পণ্যে পরিণত হয়েছে। লাভ ক্ষতির রেওয়ামিল মিলিয়ে শিক্ষকের আনন্দ বিরাগ আবর্তিত হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিয়োগ বাণিজ্যের অবস্থান দেশব্যাপী রমরমা। তাই শিক্ষক তাঁর অবস্থান ধরে রাখতে পারছেন না। এখন নিচে নামার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, কে কার আগে যাবে। সে প্রতিযোগিতায় তিনি যে একজন শিক্ষক তা অনেকসময় ভুলে যান।
সম্প্রতি শাহজালার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অপসারণ নিয়ে ছাত্রদের আমরণ অনশন চলেছে। সারা দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে শেষ পর্যন্ত কী হয় তা দেখার জন্য। যতদুর জানা যায় গত ১৩ জানুয়ারি একটি ছাত্রী হলের প্রভোষ্টের পদত্যাগ দাবী নিয়ে আন্দোলন শুরু করলে পুলিশী হামলা হয়। এরপর থেকে আন্দোলন ভিন্ন রূপ নেয়। ক্যাম্পাসে পুলিশী হামলা বা গুলি চালানোর দায় উপচার্যের উপরই বর্তায়। অবস্থা ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকে এগুতে থাকে। উপাচার্য ২৪ ঘন্টা অন্ধকারে অবরুদ্ধ থাকেন। তাঁর ঔষধ ও খাবার দিতে যেয়ে শিক্ষকেরা ব্যর্থ হয়েছেন এটা যেমন গর্হিত কাজ যা কোন ভব্যতার মধ্যে পড়ে না। তেমনি আমরণ অনশনে বসা ছাত্র-ছাত্রীরা অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণবে সেটারও অবসান ঘটানো প্রয়োজন। আন্দোলনের ভাষা হয়ে উঠেছে শাবি চত্তর। গোল চত্তরের অর্ধেক অংশ জুড়ে বিভিন্ন সেøাগানে দেয়ল ভরে গেছে। একটিতে লেখা,“স্বৈরাচার নিপাত যাক, শাবিপ্রবি মুক্তি পাক”। ভিসিকে ছাত্ররা মিথ্যাবাদী ও স্বৈরাচারী বলতেও দ্বিধা করছে না। তবে কি দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পাওয়ার পর ভিসি একটু অহম্ বোধে ছিলেন। তাছাড়া বিভিন্ন মহলে তাঁর সততার সনদ দেখে মনে হয় তিনি আত্মপ্রসাদ লাভে ব্যস্ত ছিলেন। আন্দোলন চলাকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের নিয়ে মন্তব্য ভিসির মুখে মানায় না অবম্য তার জন্য তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। ক্ষমা তো অবশ্যই করতে হবে কিন্তু দেশবাসীর কাছে তাঁর একটা ওজন হয়ে গেল। যাঁদের মুখের কথার পানে দেশবাসী তাকিয়ে থাকে তাঁদের কথা তো শুধু কথা নয় সেটাকে বাণী মনে করেন অনেকে। তাই সংযত ও আক্রমনাত্মক না হওয়া বাঞ্চনীয়। শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্য অনেককে ব্যথিত করেছে তবে একটা সত্য প্রকাশ পেয়েছে যে, সমস্যাটা মূলতঃ ইগো। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রিয় স্যারের একটা কথা মনে পড়ছে, তিনি বলেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যারদের ছোট খাটো দু’একটা তার ছেড়া আছে, ঐটা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন তিনি। যদিও রহস্যের যোগান দেয় তবুও মাঝে মধ্যে অনেক ছাত্র দীর্ঘমেয়াদী খেসারত দেয়। ছাত্রদের ইগো বেশিরভাগই আবেগতাড়িত ও অদূরদর্শী কিন্তু শিক্ষকদের ইগো পরিণত ও দূরদর্শী। একটু সময় দিলেই ছাত্র তার ভুল বুঝতে পারে এবং অনুতপ্ত হয়। এটা কিন্তু শিক্ষকের বিজ্ঞতায় ধরা পড়ে তবুও অনেক সময় দেখা যায় শিক্ষক ইগো থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। দেশবাসী স্বস্তি পেয়েছে ড. জাফর স্যারের অনুরোধে অন্ততঃ অনশন ভেঙেছে ছাত্র-ছাত্রীরা। মরণপণ অনশনে ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল তেমনি বিদ্যুৎ, পানি,খাদ্য, ঔষধ ইত্যাদি ব্যতীত ২৪ ঘন্টা ভিসি আটক থেকে দেশবাসীকে উদ্বিঘ্ন করে তুলেছিল। যদি কোন অঘটন ঘটতো দায় স্খলনের সুযোগ খুঁজতো অনেকেই। সবাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন।
ছাত্র- শিক্ষক সম্পর্ক মধুর, শাশ্বত ও চিরকালীন। এই মধুর সম্পর্কে যখন তিক্ততা সৃষ্টি হয় তখন তা অসহ্য মনে হয়। সম্পর্ক যত মধুর হবে তিক্ততা ততই বিকুট হবে। যেমন ঘি পঁচরে বিষ হয়। ভাল জিনিস পচলে দুর্গন্ধ বেশি ছড়ায়। তাই কোন ঘটনা ঘটলে শুরুতেই গুরুত্ব দিয়ে নিষ্পত্তি করা বাঞ্চনীয়। অহেতুক কচলে তিতো করা অনর্থক বরং অনেকক্ষেত্রে বিপরীত ফল হতে পারে যা কোনক্রমেই কাঙ্খিত নয়। অধিকাংশ মানুষই শান্তিপ্রিয়। কতিপয় মানুষের কৌতুহল নিবৃত্তির জন্য অকারণে প্রলম্বিত করে দেশবাসীকে উদ্বিগ্ন করার কোন যুক্তি নাই। ভবিষ্যতে অনুরূপ ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্য সরকারের সদয় দৃষ্টি ও পদক্ষেপ কামনা করি।
লেখক : সাধন চন্দ্র মণ্ডল, সাবেক ব্যাংকার