দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে এখন অনাবিল শান্তি

দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে এখন অনাবিল শান্তি
নিউজ ডেস্ক  : বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম বনাঞ্চল সুন্দরবনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছে উপকূলীয় অধিবাসীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ। জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে তারা বড় আতঙ্ক ছিল জলদস্যু ও বনদস্যুদের উৎপাত।ডাকাতি ও অপহরণের ভয়ে কোষ্ঠাসা ছিল এই অঞ্চলের বিভিন্ন পেশাজীবীরা। তবে, দীর্ঘ সময় পর ২০১২ সাল থেকে সুন্দরবনের জলদস্যু দমনের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করে বাংলাদেশ সরকার।র‌্যাবের বিভিন্ন অভিযানের মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালের ৩১ মে মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সুন্দরবনের দস্যুমুক্তকরণ শুরু হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনের (বাংলাদেশ অংশে) বন ও জলদস্যুতার অবসান ঘটে।তবে, এখনও সুন্দরবনের গহীনে ছোট ছোট কয়েকটি দস্যু দল থাকলেও র‌্যাবের কঠোর তৎপরতায় তারা সক্রিয়া হতে পারছে না। র‌্যাবের নিয়মিত টহল ও নজরদারিতে সুন্দরবনে এখন শান্তির সুবাতাস বইছে। দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের তিনটি বছর অতিবাহিত হতে যাচ্ছে।  এদিকে সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটক বাড়ছে, মানুষের গমনাগমন বেড়েছে। সেসঙ্গে বাঘ ও হরিণসহ বণ্যপ্রাণীর সংখ্যাও বেড়েছে। সুন্দরবনের বৈচিত্র্য আগের চেয়ে অনেকাংশে বেড়েছে।অতীতে যারা কুখ্যাত বন ও জলদস্যুতার মাধ্যমে ডাকাতি ও অপহরণে জড়িত ছিল, আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সামাজিক বিভিন্ন পেশায় কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছেন তারা। তবে, দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের আবারও যাতে কোনো দস্যু বাহিনীর আবির্ভাব না ঘটে, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।  দস্যুমুক্ত রাখতে সুন্দরবনের দুবলার চর ও সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জে দুটি ক্যাম্প স্থাপন করেছে র‌্যাব। নিয়মিত ফুটপ্যাট্রল, নৌ প্যাট্রলও করছে র‌্যাব। আত্মসমর্পণকারী জলদস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে চলার জন্য সরকারের পক্ষ সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সেসঙ্গে আত্মসমর্পণকারী দস্যুদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। সন্তানদের শিক্ষার পাশাপাশি আত্মসমর্পণকারীদেরও শিক্ষার বিষয়ে ভাবতে শুরু করেছে র‌্যাব।শনিবার (৩০ অক্টোবর) বিকে র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, সুন্দরবনের দস্যুতার বিরুদ্ধে আমাদের সতর্ক বার্তা জারি ছিল। এখনো তা জারি রয়েছে। এখন জলদস্যুতা শূন্যের কোঠায় নেমেছে। আত্মসমর্পণ করে যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে তাদের আবার্ও বিপথে নেওয়া চেষ্টা যারা করবে, তাদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তাই নেবে র‌্যাব। আত্মসমর্পণকারী অনেকেই জানিয়েছেন, তাদের সন্তান স্কুলে গেলে বাবার পরিচয় দিতে পারতো না। কিন্তু আত্মসমর্পণের পর তারা আজ বুক ফুলিয়ে বলতে পারছে বাবা কি করে। লজ্জিত হওয়ার মতো আর কিছু নেই। বরং তারা গর্বিত কন্ঠে বলতে পারে আমার বাবা দোকানদার, মাঝি কিংবা জেলে।সুন্দরবনের আত্মসমর্পণকারী দস্যুদের শিক্ষার বিষয়ে র‌্যাবের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নৈশস্কুলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যারা ভালো পথে এসেছে তাদের জন্য গুচ্ছ আকারে পড়াশোনার উদ্যোগ কিভাবে শুরু করা যায় সেটা নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আর তাদের পরিবারের জন্য সন্তানরা যেন নিয়মিত স্কুলে যায় সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।তিনি বলেন, সুন্দরবন উপকূলে আশির দশকে মানুষ যেতে পারতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে একটি টাস্কফোর্স গঠন করার পর সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর থেকে জলদস্যুরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অভিযানে ফেরারি জীবন শুরু করে। পরে র‌্যাবের হাতে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া আসতে থাকে। পালিয়ে থাকা জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে থাকে দস্যুরা। তাদের মধ্যে বোধদয় হয় যে, জলদস্যুতা কোনো সম্মানজনক পেশা নয়। এরচেয়ে স্বল্প আয়েও সম্মান থাকে সেটাই গর্বের। বরং ভালো থাকা যায়।র‌্যাবের প্রধান আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, র‌্যাব ২০১৬ সালের ৩১ মে থেকে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি সুন্দরবনে জলদস্যুমুক্ত করার কাজ শুরু করে। এই সময়ে ৪২৬টি অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলা-বারুদসহ ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন সদস্য র‌্যাবের হাতে আত্মসমর্পণ করে। সম্পূর্ণরূপে জলদস্যু মুক্ত হওয়ারর পর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করেন। গত তিন বছর ধরে সেই সাফল্যকে র‌্যাব ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।সুন্দরবনে এখন আর ডাকাতি, অপহরণ ও হত্যা দেখা যায় না। জেলেদের কষ্টার্জিত উপার্জনের ভাগও কাউকে দিতে হচ্ছে না। বন্যপ্রাণীসহ সুন্দরবনের মাওয়ালি, বাওয়ালি, বনজীবী, সবাই নির্বিঘ্ন জীবনযাপন করছে। এখন পর্যটক, দর্শনার্থী, জাহাজের নাবিকেরা সুন্দরবনে যেতে পারছে। র‌্যাব বন ও জলদস্যু মুক্ত সুন্দরবন গড়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রতিনিধি, বন বিভাগ, স্থানীয় বাসিন্দা, বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিশেষ করে সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানান র‌্যাব ডিজি। সুন্দরবন ছাড়াও অন্যান্য নদী ও সমুদ্র উপকূলে জলদস্যুতার খবর রয়েছে। সেসব এলাকায় র‌্যাব কোনো ব্যবস্থা নেবে কিনা? জানতে চাইলে র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, কোনো অপরাধীকে শুধু অভিযান কিংবা পেট্রলিং দিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব না। আমরা গ্রেফতার করি, আইনের আওতায় নিয়ে আসি। কোনো এলাকায় কিছু ঘটলে সেখানে র‌্যাব উপস্থিত হয় কাজ করে। আমাদের সংশ্লিষ্ট এলাকায় ক্যাম্প আছে। গোয়েন্দা কার্যক্রমও চলমান।র‌্যাবের নৌ উইংকে শক্তিশালী করার কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কিনা? জানতে চাইলে র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপত্তার জন্য র‌্যাবের নৌ উইংকে শক্তিশালী করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে। এলক্ষ্যে প্রতিবছরই কিছু না কিছু সংযুক্ত হচ্ছে র‌্যাবের নৌ উইংয়ে। আমরা বেশ কিছু নৌযান সংগ্রহ করেছি। আরও করা হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয়টি একটি চলমান প্রক্রিয়ায়। সুন্দরবনসহ উপকূলীয় এলাকায় নৌ -লাচলের র‌্যাবের সক্ষমতা আছে।র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, ঈদসহ বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে মানবিক সাহায্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও করোনাকালীন সময়েও তাদের সহযোগিতা করা হয়েছে। দস্যুপনা ছেড়ে যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন তাদের প্রত্যেককে এক লাখ করে টাকা দিয়েছে সরকার। র‌্যাবও বিভিন্ন সময় মানবিক আর্থিক ও সামাজিক সহায়তা দিয়েছে।সম্প্রতি র‌্যাবের পুনর্বাসন চাহিদা একটা সমীক্ষা চালানো হয়। যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও চাহিদা জানতে চাওয়া হয়। তাদের মধ্যে কেউ বসতি ঘর, দোকান, কেউ নৌকা, কেউ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে জাল চেয়েছেন। তাদের প্রয়োজনীয়তা জেনে র‌্যাব সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।সুন্দরবন দিবসের তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে আত্মসমর্পণকারী সদ্যুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১০২টি ঘর করে দেওয়া হয়েছে। জিনিসপত্রসহ ৯০টি মুদি দোকান, ১২টি জাল ও মাছ ধরা নৌকা, ৮টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা দেওয়া হচ্ছে। আর ২২৮টি গবাদিপশু দেওয়া হচ্ছে। যদি অসুখ-বিসুখে গরু মারাও যায় সেজন্যও বরাদ্দ থাকবে বলে জানিয়েছে র‌্যাব।সুন্দরবনের পরিবেশ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় র‌্যাবের সদস্যরা কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুন্দরবন কেন্দ্রিক আর আগের মতো কোনো ঘটনা ঘটছে না। আসলে কিছুই যে ঘটে না তা নয়। তবে, তা হিসেবে খুবই নগণ্য। ওই এলাকায় কাজ করা খুবই কঠিন। আমাদের সদস্যরা অপেক্ষা করে কখন বৃষ্টি আসবে। মিঠা পানি সংগ্রহ করবে। কারণ সেখানে নোনা পানি। এতো কষ্ট করছে র‌্যাব সদস্যরা সেখানকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। সেখানে আইন-শৃঙ্খলাসহ সার্বিক পরিবেশ অনুকূলে রয়েছে। আমরা প্রায়ই বন বিভাগ নিয়ে অভিযানে যাই। আমাদের সেখানে পরিবেশগত প্রশিক্ষণ না থাকলেও বনবিভাগের সঙ্গে কাজ করি।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

বড়াইগ্রামে নির্যাতিত আ’লীগ কর্মীর বাড়িতে বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী

বগুড়ার কনসার্টে যুবক খুন