সুজা উদ্দিন রোমেন: তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল) ১৯৬৮ সাল থেকে দেশে বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস বিতরণ করে আসছে। আর রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় তিতাসের যে সরবরাহ লাইন রয়েছে তার অধিকাংশই ওই সময় স্থাপন করা। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় পাইপলাইন সম্প্রসারণের কাজ করা হলেও লাইন প্রতিস্থাপনের কোনো কাজ করা হয়নি। এখন পর্যন্ত তিতাস ১৩ হাজার ১৯৬ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করেছে। যার মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি পাইপলাইনের বয়সই পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব। আবার কোনো কোনোটির বয়স ৫৫ বছরেরও বেশি। ফলে অধিকাংশ পাইপলাইনই তার জীবনকাল পেরিয়ে গেছে। আর মেয়াদোত্তীর্ণ ওসব পাইপলাইনের কারণে গ্যাস সরবরাহে চাপ কম থাকে। ফলে ভোগান্তিতে পড়ে গৃহস্থালির গ্রাহকসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা। পাশাপাশি পুরনো পাইপলাইনের লিকেজের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনাও ঘটছে। জ্বালানি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে গ্যাস বিতরণে টিজিটিডিসিএল হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির শুধুমাত্র যে পাইপলাইনই পুরনো তাই নয়, অবস্থানগত দিক থেকেও লাইনগুলো বেশ জটিল। ওসব লাইনের কোনো সুনির্দিষ্ট ম্যাপ বা নকশা নেই। পাশাপাশি যথাযথ তদারকির অভাবে তিতাসের মূল লাইন থেকে প্রচুর অবৈধ সংযোগ দেয়া হয়েছে। ফলে নানা ধরনের সিস্টেম লসের ফাঁদে পড়ে বাড়ছেই তিতাসের অনাদায়ী গ্যাস বিলের পরিমাণ। আবার অবৈধ সংযোগে লিকেজের ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ছে। যদিও অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হয়। আর এখন পর্যন্ত ৮২৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে অবৈধ সংযোগ শনাক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে ৭০৮ কিলোমিটার বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, তিতাসের গ্রাহক সংখ্যা ২৮ লাখেরও বেশি। আর প্রতিষ্ঠানটির মোট পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য ১৩ হাজার ১৩৮ কিলোমিটার। যার মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ৭ হাজার কিলোমিটার। তাছাড়া নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর ও কিশোরগঞ্জেও তিতাসের পাইপলাইন রয়েছে। কিন্তু ঢাকায় তিতাস গ্যাসের পাইপলাইন কোনদিকে কীভাবে গেছে সে বিষয়ে কোনো ম্যাপিং বা পাইপলাইনের নকশার কোনো তথ্য তিতাসের কাছে নেই। আর সুনির্দিষ্ট নকশা না থাকার কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি যেমন রয়েছে, তেমনি বাড়ছে অবৈধ সংযোগের পরিমাণও। ফলে অবৈধ সংযোগের কারণে প্রতিনিয়ত তিতাস গ্যাসের বকেয়ার পরিমাণও বাড়ছে। গত জুন মাস পর্যন্ত তিতাস গ্যাসের বকেয়ার পরিমাণ ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি ছিল। মূলত অনির্ধারণযোগ্য অবৈধ গ্যাস সংযোগের ফলেই প্রতিনিয়ত অনাদায়ী অর্থের পরিমাণ বাড়ছে। অথচ অবৈধ সংযোগের বিষয়ে আইনে যেসব ব্যবস্থা নেবার এখতিয়ার রয়েছে, সেসব কাজে লাগাতে তিতাসের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে প্রতিনিয়ত বকেয়ার পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
সূত্র আরো জানায়, ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে বিশেষ করে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জে বিপুল পরিমাণ অবৈধ গ্যাসলাইন সংযোগ রয়েছে বলে জানা যায়। আর ওসব অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বিভিন্ন সময় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে ওসব অভিযানে সবচেয়ে বড় বাধা আসে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের কারণে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয় না। বিষয়টি নিয়ে সংসদীয় কমিটির এক বৈঠকে আলোচনাকালে কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, রাজনৈতিক চাপকে গুরুত্ব না দিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। তাছাড়া বিগত ২০১৯ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অবৈধ সংযোগের মাধ্যমেই তিতাস গ্যাসে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়। অবৈধভাবে বিভিন্ন কারখানায় গ্যাসের লোড নেয়া হয়, কোথাও কোথাও লোড বাড়িয়ে নেয়া হয়। তিতাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ তিতাসে কর্মরত নয় এমন কিছু ব্যক্তির যোগসাজশে ঘুষের বিনিময়ে স্বাভাবিক সংযোগের পাশাপাশি চোরাই লাইনে সংযোগ দেয়। যার ফলে তিতাসে বড় ধরনের সিস্টেম লস তৈরি হয়।
এদিকে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি, স্বল্প চাপ নিরসন ও লিকেজ রোধ করতে পুরনো পাইপলাইন প্রতিস্থাপনের কাজ চলছে দাবি করে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ জানান, পাইপলাইন প্রতিস্থাপিত হলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে। পাইপলাইনের অবস্থানের বিষয়ে ম্যাপিং করার কাজও চলছে। তাছাড়া অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে তিতাসের ৩৬টি টিম কাজ করছে। এলাকা ভাগ করে টার্গেট নির্ধারণ করে দেয়ায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নে অভিযানে কিছু সফলতাও মিলেছে।