দোহায় কাতারের মধ্যস্থতায় আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল এ অঞ্চলে সন্ত্রাসী সংঠন হিসেবে আলোচিত আফগান তালেবান। সেই কাতার, যেখানে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনিদের বৃহত্তম ঘাঁটি, সেই তালেবান যাদের হাতে মারা পড়েছে হাজারো মার্কিন সেনা, সেই আফগান তালেবান মার্কিনিদের খাতায় যারা এখন কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন নয়!, আলোচনা ভেঙে গেল স্বীকৃত সরকার পালিয়ে গেল আর তালেবান নেতারা মধ্যস্থতাকারী কাতারি বিমানবাহিনীর গ্লোভমাস্টারে সদর্পে বাড়ি ফিরলেন। একেই বুঝি বলে অ্যান্টিক্লাইমেক্স!
২.
আশির দশকে সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে কান্দাহারে মুজাহিদিনদের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার। পরবর্তী সময়ে তিনি কান্দাহার প্রদেশের মাইওয়ান্ডে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী আফগান গৃহযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামি আফগানিস্তানের নেতা বুরহান উদ্দিন রাব্বানিদের মত মওদুদিবাদী মতাদর্শীদের বিরুদ্ধে দেওবন্দি মতাদর্শীরা জয়লাভ করে। যাদের নেতা ছিলেন মোল্লা ওমর এবং তার শালা মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার।
২০১০ সালের ০৮ ফেব্রুয়ারি, কারাচিতে এক সাধারণ তল্লাশি অভিযানে পাকিস্তান পুলিশের হাতে অপ্রত্যাশিতভাবে গ্রেফতার হন বারাদার। কিন্তু তার গ্রেফতারের খবর চেপে গিয়েছিল পাকিস্তান। দশদিন পর ওয়াশিংটন পোস্টে তার গ্রেফতারে সিআইএর কৃতিত্ব দাবি করে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাটির এক কর্মকর্তা সাক্ষাৎকার দিলে পাকিস্তান আইএসপিআর তার গ্রেফতার স্বীকার করে এই মিশনে সিআইএর সম্পৃক্ততা নাকচ করে।
তালেবানের সঙ্গে আমেরিকার ‘শান্তি’ স্থাপনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুরোধে পাকিস্তান তাকে মুক্তি দেয়। মাত্র ৯ মাস আগে তিনি মাইক পাম্পেওর সঙ্গে তার সাক্ষাতের ছবি প্রকাশ করেছিলেন আর আজ, কাবুল তার দখলে।
বাইডেন তালেবানদের বিরুদ্ধে বিজয় দাবি করছেন, আর তলেবান বলছে বিদেশিদের দোসর আশরাফ গনি পালিয়ে গেছে, যুদ্ধ শেষ, তলেবান বিজয়ী। উইন উইন সিচুয়েশন বুঝি একেই বলে।
সবপক্ষই যখন নিজ নিজ ‘বিজয়’ প্রচারে ব্যস্ত এমন সময় মধ্যপ্রাচ্য আর আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের পরাজয় দেখছেন শুধুই ডোনাল্ড ট্রাম্প!
৩.
একটু আগে সন্ধ্যা নেমেছে দুবাই শহরে। বার দুবাই থেকে ফিরছিলাম, যাব দেরা দুবাই, পথে আব্রাতে (ইঞ্জিন বোট) পার হলাম দুবাই ক্রিক। সেদিনের বাতাসটা বেশ ভালো লাগছিল। ভাবলাম বাসায় গিয়ে কী হবে, এখানেই না হয় বসি কিছুক্ষণ। দুবাই ক্রিকের পাড় ধরে আনমনে এগোলাম কিছুদূর, মিউনিসিপালটি অফিসটা দেখা যাচ্ছে, তার সামনে খোলা পরিপাটি মাঠ। কিছু চাইনিজ মিউজিক বাজিয়ে ট্রাডিশনাল নাচে সন্ধ্যার ব্যায়াম সেরে নিচ্ছে। কেউ আবার ব্যাডমিন্টন খেলছে।
আর কিছু দূর হেঁটে গিয়ে বসলাম ওয়াকওয়ের পাশের এক বেঞ্চে। কিছুক্ষণ পর লাল ফুলহাতা টি-শার্ট আর জিন্স পড়া একজন এসে সালাম দিয়ে বেঞ্চে বসার অনুমতি চেয়ে নিল। হাতে একটা ক্যান, দেখে পরিচিত মনে হচ্ছিল না তাই জিজ্ঞেস করলাম “বিয়ার?”, কারণ বিয়ার হলে এখান থেকে ওঠে পড়বো। কেউ দেখে পুলিশে ফোন করলে ঝামেলা বাড়বে। ছেলেটি একটু অপ্রস্তুত ভংগিতে সজোরে মাথা-হাত নাড়িয়ে বলল “নো! নো! নো! ব্রাদার… অ্যানার্জি ড্রিংক”। এরপর দু’জনেই হেসে উঠলাম। হাসি থামিয়ে সে জানালো আফগানিস্তান থেকে এসেছে, ডিপ্লোমা শেষ করে এখন চাকরি খুঁজছে আর জানতে চাইল আমি ইন্ডিয়ান কিনা, তাকে জানালাম আমি বাংলাদেশি । এরপর বিয়ার, চাকরি, দুবাইয়ের লাইফস্টাইল, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ইত্যকার বিষয়ে অনেক আলাপ হলো। সেদিন তার কাছে আফগানিস্তানের যে গল্প আমি শুনেছিলাম তা ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের মতই সাধারণ মনে হয়েছিল আমার। একই জীবনযুদ্ধ। ওঠার সময় তাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, “আর ইয়্যু শিউর ইট ইস নট আ বিয়ার, … আই’ম আস্কিং বিকজ… ইয়্যু আস্কড মি সো-মেনি থিংস বাট ইয়েট-টু আস্ক মাই নেইম…” আবার দুই জন হেসে উঠলাম… দুঃখ প্রকাশ করে সে আফগানি উচ্চারণে জানালো তার নাম “ইসমেইল’’ সাথে আমার নামটাও জেনে নিল।
এর আগে আফগানিদের নিয়ে আমি যা জানতাম তা ছিল নিতান্তই কৌতুক। ইসমাইল আমাকে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত আফগানিদের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে সাহয্য করেছিল। জানি না সে সেবার চাকরি যোগাড় করতে পেরেছিল কিনা; নাকি ফিরে গিয়েছিল আফগানিস্তানে। আমাদের সেই অনির্ধারিত আড্ডার এক দশক পেরিয়ে গেছে, কেমন আছ ইসমাইল? কোথায় আছ? ওই সে দিন কাবুল এয়ারপোর্টে ছিলে তুমি? … হায়।