শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ: বাড়ছে ইউটিউব-টিকটক আসক্তি

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ: বাড়ছে ইউটিউব-টিকটক আসক্তি
ঢাকা: করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে টানা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ আছে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ সবধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কোন কোন প্রতিষ্ঠান অনলাইনে কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করলেও বেশিরভাগ সময়েই অবসর সময় পার করছে শিক্ষার্থীরা। আর এই অবসরে ইউটিউব, টিকটক কিংবা লাইকির মতো প্ল্যাটফর্মে আসক্ত হয়ে পড়ছে তারা।
গেল বছরের মার্চে দেশে করোনা রোগীর শনাক্তের পর থেকে এর সংক্রমণ মোকাবেলায় বন্ধ ঘোষণা করা হয় সবধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেই এখন পর্যন্ত এখন পর্যন্ত বন্ধই আছে সেগুলো। কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনলাইনে কার্যক্রম পরিচালনা করলেও সেটাও দিনের একটি নির্দিষ্ট ও স্বল্প সময়। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া আছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক উপস্থিতির সুযোগ না থাকায় অবসরে একরকম অলস সময় পার করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। একই সাথে অন্যান্য সহপাঠী বা বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ কমে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশে স্বাভাবিক অন্যান্য সহ-পাঠ্যক্রমের কাজগুলো করতে পারছেন না।

এই সুযোগে শিক্ষার্থীরা ঝুঁকছে ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম, টিকটক ও লাইকি’র মতো প্ল্যাটফর্মে। একটি সমীক্ষা বলছে, করোনা এর এই সময়ে এসব প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিনগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

একই সাথে বিশ্বজুড়ে ভিডিও কন্টেন্ট নির্মাতা বাড়াতে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটক নানান অফারও দিয়ে আসছে। আর সেসব অফারে থাকছে নগদ অর্থ উপার্জনের সুযোগ। এছাড়াও সময় কাটানো, বিনোদনের এবং অর্থ আয়ের পাশাপাশি এসব প্ল্যাটফর্মে চলে ভার্চুয়াল খ্যাতি অর্জনের এক অশুভ প্রতিযোগিতা।

রাজধানীর মিরপুরের এক গৃহিণী নায়েলা তাসনিম তার ১২ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে বলেন, আগে পড়াশুনা করতো কিন্তু লকডাউনের কারণে সময় কাটানোর জন্য ইউটিউবে ভিডিও দেখতো। এছাড়াও অনলাইন ক্লাসের কারণে স্মার্ট ডিভাইস দিতে হয়েছে মেয়েকে। এখন দেখি সে নিজেই কনটেন্ট বানায়। শুরুতে কয়েকদিন রান্না করলো এখন দেখি ডান্স ভিডিও বানায়। নিষেধ করলে বলে সারাদিন ঘরে করবো কি? স্কুল খুলে দিলেই ভালো হয়।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে এখনও স্মার্টফোনের প্রাপ্যতা কম, বিশেষ করে শহরের তুলনায় তৃণমূল পর্যায়ে আনুপাতিক হারে কম। আবার যাদের আছে সেখানে হয়তো ইন্টারনেট এর অবস্থা আশানুরূপ না। কাজেই বিষয়টি এখনও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে বলে আমি মনে করি যেটিকে আরও খারাপ হওয়ার আগেই আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে এমন আসক্তিও একসময় কিন্তু ছেলেমেয়েদের মধ্যে থাকবে না অর্থাৎ এখন যেটা আসক্তি সেটার প্রতিও কিন্তু আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে তারা।

তবে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি ও পূর্ব প্রস্তুতি নিশ্চিত করে পরিস্থিতি বুঝে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যেতে পারে বিশেষ করে একদম স্থানীয় পর্যায়ে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১২টি নির্দেশনা আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে; সেগুলো পূরণ করতে হবে। এছাড়া পূর্ব প্রস্তুতির বিষয় আছে। যেমন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয়তো গাছ বড় হয়ে জঙ্গল হয়ে আছে। সেগুলো ঠিক করতে হবে। আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শিক্ষকরা কিন্তু সম্মুখ সারির যোদ্ধা। কিন্তু তাদের এখনও টিকা দেওয়া হয়নি। সবধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলিয়ে দেশে চার কোটির মতো শিক্ষার্থী এবং ১৩ লাখের মতো শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষকদের টিকা না দিয়ে তাদেরকে কী ক্লাস নিতে বাধ্য করানো যাবে? বাধ্য করালে সেটাও কী ঠিক হবে? কাজেই এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া উচিত।

ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়ার পেছনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা একটি কারণ বলে মনে করেন করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য ও মনরোগ বিশেষজ্ঞ ড. মোহিত কামাল।  তিনি বলেন, এটা সত্য যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মাঝে ইউটিউব, টিকটক এসবে উপস্থিতি বেড়েছে। আমরাই শিক্ষার্থীদের স্মার্ট ডিভাইস দিয়েছি হয়তো ক্লাস করার জন্য। কিন্তু তাদের একটি অংশ সেখানে ইউটিউবে যাচ্ছে, ফেসবুকে যাচ্ছে, এমনকি পর্নো সাইটেও যাচ্ছে। এরজন্য অভিভাবকদের আরও যত্নশীল হতে হবে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে আমরা বন্ধ রাখতে চাই তা কিন্তু না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বন্ধ রাখা হয়েছে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য। প্রধানমন্ত্রী করোনা মোকাবেলায় যে সিদ্ধান্ত নেন সেগুলো কিন্তু বিজ্ঞান নির্ভর। যে কারণে কিন্তু আমরা করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলা করতে পেরেছি। আমাদের একটি সমীক্ষা বলছে যে, ১০০ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৪ জন শিক্ষার্থীর মাঝেই করোনা হলেও কোন সংক্রমণ লক্ষণ দেখা দেবে না। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে যেটা হবে যে, তারা বাইরে থেকে করোনা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করবে আবার বিদ্যালয়েও অন্যদের মাঝে তার সংক্রমিত করবে।

ড. মোহিত কামাল আরও বলেন, কিছুদিন আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত হয়েছিল কিন্তু তৃতীয় ঢেউয়ে ভারতীয় ভ্যারিয়ান্ট এর কারণে সেটা কিন্তু হয়নি। ভারত সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিন ৮০০ ট্রাক দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। একটিতে চালক, হেল্পার এবং দুই জন শ্রমিকসহ চার জন থাকলেও প্রতিদিন তিন হাজার ২০০ মানুষ ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে দেশের আনাচে কানাচে যাচ্ছে। এদের অনেকের হয়তো করোনা হলেও লক্ষণ দেখা দেবে না। কাজেই পরিস্থিতি বিবেচনায় উন্নতির দিকে গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যেতে পারে।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

দুর্ঘটনার আশঙ্কায় জনমনে উদ্বগে বীরগঞ্জের সড়কগুলো দাপিয়ে বড়োচ্ছে কিশোর চালকরা

সন্দ্বীপে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা উদ্বোধন