সাধন চন্দ্র মণ্ডল : সুউচ্চ শৃঙ্গ থেকে সাগরের অতল পর্যন্ত সকল প্রাণী দুবাহু প্রসারিত করে অনুক্ষণ ব্যাপ্ত আছে স্রষ্টার মহিমা সংর্কীতনে। মহাকালের স্রোত সন্তরণে ক্ষুদ্র জীবনকে দীর্ঘায়িত করার প্রবনতা কেবল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের মধ্যোই লক্ষণীয়। অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে এ প্রবনতা যে নেই তা নিশ্চিত করে বলতে পারিনা কেননা তাদের ভাষা আমাদের অজ্ঞাত। তবে তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশে আমাদের প্রতীতীতে এ প্রত্যয় দৃঢ়তর করে যে, তারাও প্রতিদান প্রদানে প্রবৃত্ত হতে চায়, কৃতজ্ঞতা প্রকাশে অগ্রণী হতে চায়, দায়বোধ তাদেরকেও পীড়িত করে বরং দায় পরিশোধে তাদের আনন্দের সীমা থাকে না। কিন্তু সর্বোপরি তারা তাদের জীবনকে সার্থক করে স্রষ্টার প্রতি পরোক্ষ নিবেদনের মাধ্যমে তথা তাদের আত্ম-বলিদান হয় সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষের সেবায় যাঁরা স্রষ্টার-বন্দনায় প্রত্যক্ষভাবে ব্যাপ্ত থাকে এবং উত্তমরুপে বন্দনা তাঁদের মাধ্যমেই সম্ভব। মানুষের প্রথম কাজ শয়তানের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করা অতঃপর স্রষ্টার প্রতি তাঁর সকল উপযোগ দানের জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা এবং সকল কাজে সর্বক্ষণ তাঁর বন্দনায় নিজেকে নিবেদন করা। মানুষ ব্যতীত পৃথিবীর সকল প্রাণীই মানুষের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর তারাও মানুষের সেবায় আসতে পেরে নিজেদেরকে ধন্য বা সার্থক মনে করছে সবসময়। যেমন খেঁজুর গাছ কেটে রস বের করা হয়, সুমিষ্ট রস কার না ভালো লাগে ? কিন্তু গাছেরও তো কষ্ট হয়, তার রক্তক্ষরণই রস রুপে আমাদের কাছে সুমিষ্ট পানেয় হিসেবে প্রাপ্ত হয়, একবারও তার বেদনা আমাদের মনে আসে না। সে কষ্ট বা বেদনা গাছ হাসিমুখে সহ্য করে এই ভেবে যে, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের সেবায় লাগছে ,যাঁরা স্রষ্টার সেবা/বন্দনা করবে। কিন্তু আমরা কি তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছি?
মানুষকে শ্রেষ্ঠ করা হয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রধানতঃ তাদেরকে জাগ্রত বিবেক দেয়া হয়েছে যার মাধ্যমে তারা ভালো মন্দ বুঝতে পারে, সত্য ও অসত্য বা ন্যায় ও অন্যায়ের বিভেদ বুঝতে পারে, নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, দায় ও অধিকার, করনীয় ও অকরনীয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা জন্মে। তাঁরা নিজেদেরকে চিনতে পারে এবং তাঁর স্রষ্টাকে জানতে পারে ও তাঁর বন্দনা করতে পারে। তাঁদের মেধা মননে যে উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যার চালনায় সারা বিশ্ব তাঁদের নিয়ন্ত্রণে আসবে, সমস্ত জীবের প্রতি তাঁদের কর্তৃত্ব থাকবে, সকল জীবও তাই চায় এ শ্রেষ্ঠ জীবের সেবায় আত্মনিবেদন করে প্রকারান্তরে স্রষ্টার সেবায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করে জীবন সার্থক করতে। তাই পৃথিবীর সকল জীব(মানুষ ব্যতীত) তাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধি-বিবেচনায় তাদের দায়িত্ব কর্তব্য যথাযথ পালন(আমার বিবেচনায়) করছে বলে মনে করি। অন্ততঃ বেঈমানী করছে না এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। কিন্তু সৃষ্টির সেরা মানুষ জগতে এসেই তাঁর স্রষ্টাকে ভুলে সব আমার আমার ভাবনায় লিপ্ত থাকে। এটাকে কি বলবো? জগতের সকল জীব ও জড় বস্তুর প্রতি মানুষের অবাধ ও নিরঙ্কুশ অধিকার। এতো এতো উপযোগ দেয়া হয়েছে শুধু ভোগ করে তৃপ্ত হওয়ার জন্য, বিনিময়ে স্রষ্টার আরাধনার এতটুকু সময় হবে না? আমরা বাস্তবতায় দেখছি, অনেকেরই হয় না। তাই নিশ্চিত করে বলা যায় শ্রেষ্ঠ জীবের মধ্যে অকৃতজ্ঞ, বেঈমান, কৃতঘ্ন প্রভৃতি বিশেষণ সম্বলিত একটা বড় অংশ বিদ্যমান। তবে এই অংশ যত স্বল্প হবে ততই মঙ্গল যতই বৃহৎ হবে ততই বিপদ। দুঃখজনক হলো যত দিন যাচ্ছে এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বর্ধিত হয়েই চলেছে।
অনাদি কাল থেকে বহু জ্ঞানী-গুনী ব্যক্তি তাঁদের জীবনের লব্ধ জ্ঞান লিপিবদ্ধ করে গেছেন। আর যুগে যুগে অবতাররূপে ধরাধামে এসে স্রষ্টার অপার দানের মহিমা কীর্তন করেছেন, মানুষকে দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। সর্বোপরি আমাদের জ্ঞান বিবেক বুদ্ধি আছে তবে কেন আমরা বুঝি না। বুঝি না বলবো না, আমরা অবশ্যই বুঝি। না বোঝার ক্ষমা হয় কিন্তু বুঝে যে অন্যায় করে তাকে ক্ষমা করতে স্বয়ং স্রষ্টারও কষ্ট হবে। সকল শাস্ত্রে আছে স্রষ্টার অনুকূল গুণাবলীকে প্রশংসা করলে স্রষ্টা সন্তুষ্ট হন কিন্তু তাঁর প্রতিকূল গুণধারীকে প্রশংসা করলে নিশ্চয় তিনি সন্তুষ্ট হবেন না। এটা জেনেও যখন আমরা আনুকূল্য পাওয়ার প্রত্যাশায় প্রশংসা করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই আর এতে সফল হলে তাকে বাহবা দিতে থাকি, বলি ট্যালেন্ট আছে, যুগোপযোগী, স্মার্ট আরো কত কি। একবারও ভাবিনে অনৈতিক কাজের প্রশংসা করে আমিও অনৈতিক আবর্তে জড়িয়ে যাচ্ছি কি না? অন্যায়কে সার্পোট করা বা সহযোগিতা করা অন্যায় নয় কি ? এই সহযোগিতার ধরণ বা প্রক্রিয়া ভিন্নতর যাই হোক না কেন তা সহযোগিতাই। আর আমাদের অজান্তে তার সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম হিসাবায়ন হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নাই।
বর্তমান দূনীতি বা ঘুষ এর মাত্রা এতোই বৃদ্ধি পেয়েছে যে বিষয়টি সকলের কাছে সুপরিচিত। এর বিপরীতে যাঁরা কথা বলেন তাঁদেরকে অনেকে বোকা বা অপদার্থ বলতেও দ্বিধাবোধ করেন না। এমনকি অনেককে বলতে শোনা যায় যে, “ওনারা পান না তাই খান না, সুযোগ পেলে ওনারাও খেতেন।” সৎ, সাহসী ও নীতিবান নির্বাহীর সংখ্যা কম নয় তবে তাঁদের প্রচার বা প্রসার নেই। নিরবে নিভৃতে তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত অন্তর আলোকিত হয়ে আছে দেশ ও জাতির সেবার মহামন্ত্রে। তাঁদের জাগ্রত বিবেক ইহকাল, পরকাল ও সর্বকালের চিন্তায় সুদৃঢ়। তাঁদের পরম তৃপ্তি বা পরমানন্দ এই ভেবে যে, তাঁরা জন্মঋণ বা রক্তঋণ শোধ করে চলেছেন। এ মহান চেতনা তাদের অন্তরে সর্বক্ষণ ক্রিয়াশীল থাকে। তাঁরা ব্যক্তিক লাভ বা অনৈতিক অর্থ সংগ্রহকে মহাপাপ বলে গন্য করে।
পক্ষান্তরে যাঁরা অনৈতিক কাজে বা দূনীতিতে যুক্ত তাঁদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকে। তাঁদের বিবেক শুভ চিন্তা থেকে দুরে যেতে থাকে, সেখানে মানবিকতা লুপ্ত হয়ে যায়। তাঁদের লক্ষ্য থাকে সর্বোচ্চ পদটি অধিকার করা, তার জন্য সবকিছু করতে রাজী। চলার পথে যদি কোন অন্তরায় দেখা যায় আর তা সরাতে যদি কাউকে সাগরের অতলে ডুবাতে হয় তিনি তা করতে বিন্দুমাত্র ভাববেন না। সেখানে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, মানবিক-অমানবিক এসব ভাববার কোন অবকাশ থাকে না। সারা অন্তর জুড়ে থাকে শুধু শীর্ষ পদের হাতছানি। প্রয়োজন মতো রঙ পাল্টানোও কোন বিষয় নয়, ক্ষমতাসীন দলের সর্বোচ্চ উপযোগ তাঁর চাইই। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন মন্ত্রী মহোদয়ের তৈলসংযোগে তালিকার সর্বশেষ ব্যক্তি হয়েও পদোন্নতি পাওয়া। ক্ষমতার পালাবদলে সাময়িক বিপাকে পড়লেও তৈলের বহুমূখী গুণে এবং তৈল যথাসময়ে যথাস্থানে যথাপরিমানে প্রয়োগের অপূর্ব কৌশলে তা কাটিয়ে এখন প্রথম কাতারের আওয়ামীলীগার। এই উত্থানে তাঁর কর্মদক্ষতার চেয়ে তৈলদক্ষতার ভূমিকাই বেশি। এরজন্য তাঁর কর্মপরিকল্পনা থাকে দীর্ঘমেয়াদী। কোন্ মন্ত্রীর কবে জন্মদিন, কার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী, ছেলের জন্মদিন এসবকিছু তাঁদের মনে না থাকলেও তৈলবাজের মনে রাখতে হয়। আর বিনিদ্র রজনীতে কর্মপরিকল্পনা করে সময় অনুযায়ী সবার কাছে যেয়ে শুভ কামনা জানানো ও তাঁদের শুভাকাঙ্খী হয়ে ওঠার সুযোগ সর্বোচ্চ কাজে লাগানো হয়। কোন মন্ত্রীর স্ত্রীকে স্বাস্থ্য সেবার সহযোগিতায “মা” ডাকতে হবে, এবং দুর্বলতম স্থানে প্রবেশ করে সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়া যাবে তা তিনি ভালোমতোই জানেন। এই বিরল প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তিটি যদি এর কিয়দাংশ স্রষ্টার আরাধনায় ব্যয় করতেন তবে তাঁর জীবন সার্থক হয়ে যেতো।
দেশ ও জাতির সেবায় নিয়োজিত এই আপ্ত্যবাক্য সোৎসাহে উচ্চারিত করে জগত বিদীর্ণ করলেও তাঁদের অন্তরে অনুক্ষণ ভিন্ন সুর অনুরোণিত হয়। এতোটুকু লজ্জা লাগে না একদিন আমি মনে প্রাণে বিএনপি ছিলাম আর আজ বঙ্গবন্ধুর বড়সৈনিক। প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ অবস্থানের সাথে সাথে অর্থ উপার্জনের দ্বার উন্মোচিত, অবারিত সে সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে প্রাপ্ত অর্থ বিদেশে পাচার করে সেকেন্ড হোম বা থার্ড হোম সম্পন্ন। অনৈতিক অর্থ উপার্জন অপরাধ আবার তা বিদেশে পাচার করা মহাপরাধ। যুগপৎ অপরাধ করেও দেশসেবায় মত্ত আছি এমন প্রচার-প্রচারণা মুনাফিকের চরম সীমায় পৌঁছানোও বটে। তাছাড়া দেশ ও জাতির প্রতি চরম বেইমানী বা বিশ্বাসঘাতকতা।
নিজেকে শুদ্ধ করা প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। শিক্ষা মানুষকে পরিশুদ্ধ করে। আবার ধর্মীয় অনুশাসন মানুষকে পরিশুদ্ধ করে। ছোট থেকে এর জন্য পরিবেশ বা ফ্যামিলি স্টাটাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পরিনত বয়সেও অনেকে তওবা করে ভালো হয়ে যায়। ভাল হওয়ার বহু সুযোগ আছে, শুধুমাত্র অন্তরের সদিচ্ছাটুকু থাকতে হবে। ধর্মের প্রতি একাগ্র হয়ে অনুশীলন করতে থাকলে সহজে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা যায়। অন্যদিকে সুশিক্ষিত মানুষ তাঁদের জাগ্রত বিবেক দ্বারা শুদ্ধ হয়ে যায়। আত্মশুদ্ধির প্রধান অন্তরায় হলো নিজের লোভ, প্রত্যাশা ও যেকোন প্রকারে উর্দ্ধে ওঠার অদম্য ইচ্ছা। আর সর্বোচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি যখন এটা করে তখন তাকে জ্ঞানপাপী বলাই শ্রেয়।
তাই বলে আমি ভাল কাজের প্রশংসা থেকে বিরত থাকতে বলছি না বরং ভাল কাজের প্রশংসা শত মুখে সহস্রধারায় প্রকাশের জন্য উৎসাহিত করছি। ভাল কাজের প্রশংসা করলে তা সঞ্চারিত হতে থাকে এবং অন্যরাও ভাল কাজ করার প্রেরণা পায়। কিন্তু তাঁর মন্দ কাজ যেটা জানা সত্বেও আমরা এড়িয়ে যাবো বা যাই ক্ষতি নেই। তবে তাঁর ভালো কাজের প্রশংসা করতে যেয়ে যদি তাঁকে সর্বগুণে গুণান্বিত, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিদিত করার চেষ্টা করি তবে কতিপয়ের কাছে তা হাস্যকর মনে হবে। ভোরকে দিন বলা, সন্ধ্যাকে রাত বলা তাও সহ্য করা যায় কিন্তু দিন দুপুরকে রাত দুপুর বলা বা রাত দুপুরকে দিন দুপুর প্রমান করার মতো বাতুলতা সমাজ সংসারে আর আছে বলে মনে হয় না। সাধুকে সাধু বলি, চোরকে চোর বলার প্রয়োজন নেই ওটা স্রষ্টার সমর্পনে রাখাই উত্তম।