অনুপ বালো : করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যায়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের শ্রেণীকক্ষে ফেরা অনিশ্চয়তা । প্রায় ১৫ মাস ধরে দেশেরসক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। বইয়ের জগৎ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। মানসিক চাপে শিক্ষার্থীদের আত্নহত্যা, মাদকে আসক্তি, অনলাইন ক্লাসে আগ্রহ কম, চিন্তিত অভিভাবক ও অনেক শিশুকে স্কুলে ভর্তি করা হয়নি। এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা কবে হবে তাও এখন অনিশ্চিত।
তবে বিকল্প মূল্যায়ন নিয়ে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা দীপু মনি। তিনি বলেছেন, চলতি বছরে করোনার কারণে আটকে থাকা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হবে কিনা, তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। এখনও চেষ্টা হচ্ছে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি অনুযায়ী পরীক্ষা না নিতে পারলে বিকল্প কী মূল্যায়ন হতে পারে, সেসব নিয়েও কাজ চলছে বলে শিক্ষামন্ত্রী জানান।
শীঘ্রই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হচ্ছে না, এমনটা ইঙ্গিতও দিলেন মন্ত্রী। কবে নাগাদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে জানতে চাইলে দীপু মনি বলেন, গত বছরের শেষে ও এ বছরের শুরুতে সংক্রমণের হার কমিয়ে আনতে পেরেছিলাম। করোনা সংক্রমণ এখন ঊর্ধ্বগামী। যেখানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫ শতাংশের নিচে গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার মতো একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কিন্তু এখন তো অনেক বেশি। সংক্রমণের যে ঊর্ধ্বগতি আপনারাই বলেন এই পরিস্থিতিতে কীভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা যায়। তিনি জানান, সংক্রমণের হার ১৩ শতাংশের বেশি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সময় জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, কী করে বলবো বলেন। আমাদের কারো পক্ষে বলা সম্ভব না। আমরা আশা করেছিলাম, মার্চ মাসে খুলে দেবো। প্রতিদিন সিনারিও চেঞ্জ হচ্ছে। লকডাউন মানলে সংক্রমণ কমবে। আমরা তো মানছি না, আর মানছি না বলেই বার বার খারাপের দিকে যাচ্ছে।
ঢাকার মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ুয়া দুই শিক্ষার্থীর অভিভাবক ডা. শাহদাৎ হোসেন বলেন, অনলাইনে নামমাত্র ক্লাস নেয়া হচ্ছে। নিয়মিত টিউশন ফি আদায়ের লক্ষ্যেই এটি করা হচ্ছে। শ্রেণীশিক্ষকরা চারটি-পাঁচটি বিষয়ের অনলাইন কোচিংও চাপিয়ে দিয়েছেন। এতে দুই সন্তানের জন্য প্রতিমাসে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে।
অনলাইন শিক্ষা ও কোচিংয়ে কোন মেধার বিকাশ ঘটছে না- মন্তব্য করে এই অভিভাবক বলেন, দুই সন্তানকে দুটি স্মার্ট ফোন সেট কিনে দিতে হয়েছে। কোন কারণে শিক্ষকের দেয়া পড়া না পারলে ‘বিদ্যুৎ চলে গেছে, নেট সংযোগ কাজ করছে না, কিছুই শুনা যাচ্ছে না’ এসব বলা হয় শিক্ষককে। অনেক সময় শিক্ষকরাও এসব অজুহাত দেখিয়ে পাঠদানে বিরত থাকেন। এই সুযোগে সন্তানরা মোবাইলে ‘ভিডিও গেম’এ আসক্ত হয়ে পরছে।’
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদরা বলছেন, অনলাইন পাঠদানের সুফল গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা পাচ্ছে না। শহর অঞ্চলেও এর সুফল পুরোপুরি মিলছে না। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে।
গত বছর যেসব ছাত্রছাত্রী একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে তারা এখন পর্যন্ত কলেজে যাওয়ারই সুযোগ পায়নি। এসব শিক্ষার্থী শ্রেণীশিক্ষকদেরও দেখা পায়নি। অথচ এই স্তরের ছাত্রছাত্রীদের ২০২২ সালে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বসার কথা রয়েছে।২০২২ সালের এইচএসসি ও সমপর্যায়ের পরীক্ষার্থীদের খুব সহসাই শ্রেণী কার্যক্রমে ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না-এমনটি ধরে নিয়ে এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের জন্য ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের জন্য সাত বিষয়ে ৬০টি ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ প্রণয়ন করে গত সপ্তাহে মাউশিতে জমা দিয়েছেন। প্রতি সপ্তাহে ২টি করে ৩০ সপ্তাহে এই ৬০টি ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ বাস্তবায়ন করবে শিক্ষার্থীরা।
সাতটি বিষয় হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান, হিসাব বিজ্ঞান, পৌরনীতি ও যুক্তিবিদ্যা। জানতে চাইলে মাউশি’র পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, করোনা সংক্রমণ কবে নিয়ন্ত্রণে আসবে সেটা বলা মুশকিল। আবার যখনই স্কুল-কলেজ খুলবে তখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা নিতে হবে। অন্যান্য শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষাও আছে।
এসব কারণে স্কুল-কলেজ খুললেও ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীর শ্রেণী কার্যক্রম পুরোদমে চালু নাও হতে পারে- জানিয়ে মাউশি পরিচালক বলেন, এ কারণে আগামী বছরের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ৬০টি ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ প্রণয়ন করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই এর বাস্তবায়ন শুরু হবে।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) বিবিএ তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সামির ইয়াছার। করোনা শুরুর পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এই শিক্ষার্থী তার চার বছরের শিক্ষাজীবনের দ্বিতীয় বর্ষের পুরো সময়ই অনলাইনে ক্লাস করে কাটিয়েছেন। তিনি জানান, সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন অনলাইনে তাদের ক্লাস হচ্ছে। এমনকি পরীক্ষাগুলোও হচ্ছে অনলাইনে। অনলাইন ক্লাসে গড়ে মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেক উপস্থিত থাকে। তবে সরাসরি ক্লাসে থেকে একজন শিক্ষার্থী কোনো বিষয় যতটা ভালোভাবে বুঝতে পারে, তা অনলাইনে পারে না। তিনি জানান, ক্লাস প্রেজেনটেশনও অনলাইনে দেওয়া সম্ভব নয়।
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি উদ্বিগ্ন অভিভাবকরাও। এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের অনেকেই আগের মতো স্বাভাবিকভাবে ক্লাসে যেতে পারবে কি না তা নিয়ে মা-বাবারা দুশ্চিন্তায় আছেন। করোনা সংক্রমণের জন্য কোমলমতি অনেক শিক্ষার্থীকে স্কুলে ভর্তি করানোর বয়স হলেও অভিভাবকরা এখনো তাদের স্কুলে দেননি। আবার ক্লাস না থাকায় সময় কাটাতে শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ অনলাইনে বিভিন্ন অ্যাপস, যেমন ‘টিকটক’, ‘লাইকি’তে অশ্লীল ভিডিও তৈরি করছে। কেউ কেউ মাদকে আবার অনেকে অনলাইন ভিডিও গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে।
মিরপুরের এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাছিমা আক্তার বলেন, দেড় বছর ধরে ছেলে ক্লাসে যায় না। সারা দিন বন্ধুদের সঙ্গে পাড়ায় আড্ডা দেয়। রাত করে বাসায় ফেরে। সারা রাত ফেসবুক আর ভিডিও গেম খেলে ভোরে ঘুমায়। দুপুরে ঘুম থেকে ওঠে। লেখাপড়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমার কাছ থেকে প্রতি সেমিস্টারের টাকা ঠিকই নিচ্ছে। কিছু শিখছে কি না জানি না। স্কুল খুললে ঠিকমতো ছেলে ক্লাসে যাবে তো? এটি ভেবেই এখন ভয় হচ্ছে!’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, অনলাইনে ক্লাস, সামাজিক যোগাযোগ এবং বিনোদন সবই ইন্টারনেটভিত্তিক হয়ে পড়া শিশুর জন্য নেতিবাচক। কারণ এতে একটি শিশু বেশি সময় অনলাইনেই কাটাচ্ছে। ফলে শিশুর ওপর আলাদাভাবে মানসিক চাপ পড়ার আশঙ্কা আছে।