নিজস্ব প্রতিবেদক : টিকটকে বন্ধুত্বের ফাঁদ, অতঃপর নানা প্রলোভন দিয়ে ভারতে নারী পাচার। এরপর সীমান্তবর্তী কয়েকটি বাড়িতে রেখে শারীরিক ও বিকৃত যৌন নির্যাতন করে পাচার হওয়া নারীদের বাধ্য করা হয় পতিতাবৃত্তিতে।সংশ্লিষ্টরা জানান, নারী পাচারে ব্যবহারের জন্য সীমান্ত এলাকার বাংলাদেশ ও ভারত অংশে কয়েকটি বাড়ি আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। মূলত ওইসব বাড়ির মালিকরাও পাচারকারী দলের সদস্য। বেশ কয়েকটি ধাপে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের ফাঁকি দিয়ে সম্পন্ন হয় পুরো পাচার প্রক্রিয়া।সীমান্ত পাড়ি দেওয়া, ভারতীয় আধারকার্ড বানিয়ে তরুণীদের অন্যত্র পাঠানোর প্রক্রিয়া শেষ করতে সেই সব বাড়িতে কখনো সপ্তাহখানেক সময় নেন চক্রের সদস্যরা।সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে যৌন নির্যাতনের ভাইরাল ভিডিওর সূত্র ধরে ধারাবাহিক তদন্তে ভয়াবহ নারী পাচারকারী চক্রের সন্ধান পায় পুলিশ। কয়েক বছরে ওই একটি চক্রের হাত ধরেই ভারতে পাচার হয়ে গেছে সহস্রাধিক নারী।এরপর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও পুলিশের পৃথক অভিযানে চক্রের অন্যতম সদস্য আশরাফুল মন্ডল ওরফে বস রাফিসহ সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ।সবশেষ সোমবার (০৭ জুন) সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ওই সংঘববদ্ধ আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য আমিরুল ইসলাম (৩২) ও আবদুস সালাম মোল্লাকে (৩৬) গ্রেফতার করেছে ডিএমপি তেজগাঁও বিভাগ। ভারতে পাচার হয়ে ৭৭ দিন পর পালিয়ে দেশে আসা এক তরুণীর হাতিরঝিল থানায় দায়েরকৃত মামলায় তাদের গ্রেফতার করা হয়।পুলিশ জানায়, ভারতে নারী পাচারের ঘটনায় গ্রেফতাররা জড়িত আরও কয়েকজনের নাম বলেছেন। একই সঙ্গে পাচার হওয়া তরুণীদের কীভাবে ভারতে পাঠানো হয়েছে, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।এদিকে, ভারতে ৭৭ দিন শারীরিক ও বিকৃত যৌন নির্যাতনের শিকার ওই তরুণী হাতিরঝিল থানায় দায়েরকৃত মামলায় ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। পাচারের পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে লোমহর্ষক নানা তথ্য উঠে এসেছে তার দেওয়া মামলার এজাহারে।ভুক্তভোগী ওই তরুণীর বর্ননা অনুযায়ী, তাকে কুষ্টিয়ায় লালন শাহ মাজারে ‘টিকটক হ্যাংআউটের’ কথা বলে সাতক্ষীরায় নিয়ে যান কথিত টিকটক স্টার ও নারী পাচারকারী চক্রের অন্যতম সদস্য রিফাদুল ইসলাম হৃদয়। সাতক্ষীরার বাসটি একটি সিনেমা হলের সামনে থামে। কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আজান হয়, হৃদয় অস্থিরভাবে হাঁটাহাঁটি করতে করতে মোবাইলে কথা বলতে থাকেন।১০ মিনিট পর ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী একজন লোক মোটরসাইকেল চালিয়ে হৃদয় ও ভুক্তভোগী তরুণীর কাছে আসেন। হৃদয় লোকটিকে বলেন, আমরা ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া যেতে চেয়েছিলাম। ভুল করে সাতক্ষীরা এসেছি। দ্রুত কুষ্টিয়া যাওয়ার কোনো বাস আছে কিনা।মোটরসাইকেলে আসা লোকটি জানান, সামনে কুষ্টিয়ার শেষ বাসটি আছে। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই ছাড়বে। ওই ব্যক্তি হৃদয় ও তরুণীকে দ্রুত মোটরসাইকেলে চড়তে ইশারা করেন। হৃদয় ও তরুণী মোটরসাইকেলে চড়েন। ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর একটি টিনশেড বাড়ির সামনে মোটরসাইকেলটি থামে।মোটরসাইকেলের চালক তাদের জানান, বাস চলে গেছে। রাতে আর বাস নেই। হৃদয় মোটরসাইকেল চালককে অনুরোধ করেন যেন তাদের শহরে কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দেন। হৃদয় জানান, তার কাছে ৩০০ টাকা আছে মাত্র। মোটরসাইকেল চালক বলেন, এত কম টাকায় সাতক্ষীরা সদরে কোনো হোটেলে সিঙ্গেল রুমও পাওয়া যাবে না। তাছাড়া দুজনের তো দুই রুম লাগবে।মোটরসাইকেল চালক পাশের একটি বাসা দেখিয়ে বলেন, সেখানে সস্তায় একটি পরিবারের সঙ্গে থাকা যাবে। সেই বাসায় যেতে অস্বীকৃতি জানান তরুণী।অভিযোগে তরুণী বলেন, হৃদয় আমাকে অনুরোধ করে সেই বাসায় যেতে। যেহেতু পরিবারের সঙ্গে থাকা যাবে, কাজেই আমরা দুজন আলাদা রুমে থাকতে পারব। রাতে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলে সে বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা নেবে। সকালে সেই টাকা ক্যাশআউট করে কুষ্টিয়ায় যাবে। আমার কাছেও তেমন টাকাপয়সা ছিল না। যেহেতু হৃদয়ের কাছে পর্যাপ্ত টাকা নেই এবং সেই বাসাটিতে পরিবারের সঙ্গে আলাদা রুমে থাকা যাবে, তাই আমি সেই বাসায় থাকতে রাজি হই।তিন কক্ষের সেই বাড়িটির মালিক আলম। হৃদয় ও তরুণী বাড়িতে ঢোকার কিছুক্ষণ পর হৃদয়ের সমবয়সী আরও তিনজন এবং ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী এক নারী আসেন। হৃদয়ের সঙ্গে আসা তরুণী ও অপর তরুণীকে একটি কক্ষে থাকতে দেওয়া হয়। হৃদয় ও অন্য তিন তরুণ তৃতীয় কক্ষটিতে ঘুমান।তরুণী এজাহারে বলেন, রাত আড়াইটার দিকে হৃদয় রুমের দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে আমার নাম ধরে ডেকে দরজা খুলতে বলে। দরজা খুলে দিলে হৃদয় ও ৩০-৩৫ বছর বয়সী এক লোককে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। হৃদয় তাকে আনিস ভাই বলে ডাকে। আনিস আমাদের দেখে চলে যায়।ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে হৃদয় আবার রুমের দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে আমার নাম ধরে ডেকে দ্রুত দরজা খুলতে বলে। দরজা খুলে দেখি হৃদয়সহ অন্য তিন তরুণ রুমের সামনে দাঁড়ানো। তারা আমাদের দ্রুত রুম থেকে বের হতে বলে। আমরা দ্রুত বের হয়ে দৌড়ে বেশ দূরের একটি বাড়িতে চলে যাই।সেই বাড়িটিতে গিয়ে আমরা ছয়জন একটি রুমে ঢোকামাত্রই হৃদয় দরজা বন্ধ করে দেয়। হৃদয় বলে, পুলিশের গাড়ি এসেছে। সকাল সাতটার দিকে হৃদয় জানায়, বাইরে পুলিশ ঘোরাঘুরি করছে। পুলিশ না চলে গেলে বাড়ি থেকে বের হওয়া যাবে না!
সীমান্তযাত্রার ফাঁদ
সকালে একজন ছয়জনের নাশতা নিয়ে আসেন। তার নাম আবদুল কাদের। তিনি জানান, সামনেই ভারতের বর্ডার। এই এলাকায় এলে কেউ সেখানে না ঘুরে ফেরে না।তরুণী বলেন, যেহেতু হৃদয় টিকটক করে, সে ভারতীয় বর্ডারের কাছে গিয়ে ছবি তুলতে চায়, আমাকে তার সঙ্গে যেতে অনুরোধ করে। আবদুল কাদেরকে অনুরোধ জানায়, ভারতীয় বর্ডারের কাছাকাছি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে। প্রায় ১০-১৫ মিনিট পর দুটি লাল মোটরসাইকেল নিয়ে মেহেদী হাসান বাবু ও মহিউদ্দিন নামে দুইজন আসেন। তারা সবাইকে দ্রুত বের হতে বলেন।এই মেহেদী হাসান বাবু, আবদুল কাদের ও মহিউদ্দীনকে মঙ্গলবার (০১ জুন) রাতে গ্রেফতার করে পুলিশ।তরুণী বলেন, ১০-১৫ মিনিট হাঁটার পর এক জায়গায় দেখি, আমার বয়সী চারজন মেয়েসহ হারুন নামে এক লোক দাঁড়িয়ে আছেন। সেখান থেকে আনিস, আবদুল কাদের ও অপর তরুণীর সঙ্গে থাকা তিন ছেলে চলে যায়। মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও হারুনের সঙ্গে হৃদয়সহ আমরা হাঁটতে থাকি। ৩০-৪০ মিনিট হাঁটার পর ভারতীয় বর্ডারের সামনে আমরা বসে থাকি।প্রায় দুই ঘণ্টা বসে থাকার পর মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও হারুন আমাদের একটা পাকা রাস্তায় তুলে হাঁটতে বলেন। পাকা রাস্তার মাথায় দাঁড়ানো ট্রাউজার ও গেঞ্জি পরিহিত এক লোককে দেখিয়ে বলেন, আনিস ভাই ওনাকে বলে দিয়েছেন, দ্রুত চলে যাও। হৃদয়সহ আমরা হেঁটে তার কাছে গেলে তিনি আমাদের রিসিভ করেন।লোকটি দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে তাকে অনুসরণ করতে বলেন। লোকটি রাস্তা ব্যবহার না করে ক্ষেত-খামারের ওপর নিয়ে হাঁটতে থাকেন। জমি ও ক্ষেতের আইল দিয়ে প্রায় দুই-তিন ঘণ্টা হাঁটার পর ট্রাউজার পরিহিত ওই ব্যক্তি লুঙ্গি পরিহিত একজনের কাছে আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে চলে যান। লুঙ্গি পরা লোকটির সঙ্গে প্রায় আরও দুই ঘণ্টা হাঁটার পর এক জায়গায় গিয়ে ওই তরুণী চারটি মোটরসাইকেলসহ চারজনকে পান।হৃদয় তরুণীকে কালো রঙের একটি মোটরসাইকেলে উঠতে বলেন। মোটরসাইকেলের চালকের নাম ছিল বকুল ওরফে ছোট খোকন। বকুল জোরে মোটরসাইকেল চালিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর একটি টিনশেড বাসার সামনে মোটরসাইকেল থামায়। সীমান্তের ওপারের এই বাড়িতে দুই তরুণীকে প্রথমে রাখা হয়েছিল।ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, গত ১ জুন গ্রেফতার মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় পাচারের কাজে ব্যবহারের জন্য নির্মিত কক্ষে ভিকটিমদের অবস্থানে সহায়তার পাশাপাশি তাদের মোটরসাইকেল যোগে সীমান্তের শেষ প্রান্তে ভারতীয় দালালের হাতে তুলে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তদন্তের এ পর্যায়ে আমরা নারী পাচারকারী চক্রের অনেকের নাম পেয়েছি। তদন্তের পর সেই সংখ্যাটি নিশ্চিত হওয়া যাবে।