নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘কিচ্ছু বাইর করতে পারি নাই। ঘরের একটা পাতিলও নিতে পারি নাই।শেষ রাইতে আগুন লাগছে খালি জানটা লইয়া বাইর হইছি। আমার সব পুইড়া ছাই। কষ্ট কইরা সংসার গুছাই আর আগুনে সব পুইরা ছাই হয়ে যায়। এহন (এখন) আমগো (আমাদের) কপালটা আগুনে পুইড়া ছাই হওয়ার বাকি আছে। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন জহুরা বেগম। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে সাততলা বস্তিতে বসবাস করছেন তিনি। তার স্বামী কালাম একজন রিকশাচালক। সোমবার (৭ জুন) ভোরে সর্বনাশা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার সাজানো সংসার। ঘরের ভেতরে থাকা কোনো আসবাবপত্র, টাকা পয়সা কিছুই বের করতে পারেননি তিনি।সব হারিয়ে নিঃস্ব এই বস্তির বাসিন্দা জহুরা এখন কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।জহুরা বলেন, আমাগো কপালই পুড়া। বারবার আগুনে আমরাই শেষ হই। কষ্ট কইরা সংসারের জিনিস করি আর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ পর্যন্ত তিনবার আগুনে পুরে সব ছাই হয়ে গেছে। সাততলা বস্তিতে জহুরার ১৪টি ঘর রয়েছে। ১০টি ঘর ভাড়া দিয়ে ৪টি ঘর নিয়ে থাকতেন তার পরিবার। বড় মেয়ে মদিনাকে (২২) বিয়ে দিয়েছেন। আর ছেলে (১৬) ইউসুফ ছোট। তাদের সঙ্গেই থাকেন। তাদের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর জেলার মাদবর চরের লক্ষ্মীকান্দি গ্রামে। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে সাততলা বস্তিতে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন হজুরা বেগম। কাঁদতে কাঁদতে হজুরা বলছিলেন, কিসের মধ্যে রাইন্দ (রান্না) খামু? পাতিলও পুইড়া গেছে। ঘরের ভাড়া আর স্বামীর রিকশার ইনকাম দিয়ে ফ্রিজ, টিভি খাটসব সব জিনিস করছিলাম। কিন্তু আগুনে সব ছাই হইয়া গেছে। হাতে এখন কোনো ট্যাকাও নাই যে কিছু কিন্না খামু। সকাল থেকে না খাইয়া আছি। খালি জীবনটাই আছে। সাততলা বস্তিতে হজুরার মত অনেকেই আগুনের দহনে ক্ষতিগ্রস্ত। এই বস্তির আনুমানিক ১৫০টি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেই তালিকায় রয়েছে অনেক দোকানও।এ দিন ভোর ৪টার দিকে রাজধানীর মহাখালী সাততলা বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। এসময় র্যাব-পুলিশও ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রায় তিন ঘণ্টার প্রচেষ্টায় সকাল ৭টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে আগুনের এই ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।ফায়ার সার্ভিস বলছে, সাততলা বস্তির সব ঘরই কাঠ, বাঁশ ও টিনের তৈরি। এছাড়াও এই বস্তিতে অবৈধ গ্যাস লাইন ও বিদ্যুতের সংযোগ রয়েছে। আগুন লাগার পর তা দ্রুত সময়ের মধ্যে বস্তিতে ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, বস্তিতে টিনের ঘর অনেক বেশি সেপারেশন হওয়ায় আমাদের আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে। এছাড়া দাহ্য বস্তুর উপস্থিতি বেশি ছিলো। তাই আগুন দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে।আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এখানে প্রচুর পরিমাণে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন রয়েছে। আমরা প্রাথমিকভাবে মনে করছি, এই দুইটার থেকে যেকোনো একটি কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। তবে, তদন্ত করে আগুনের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে জানা সম্ভব হবে।এদিকে বস্তিতে আগুনের ঘটনার পর দুপুরে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়ে আতিকুল ইসলাম। তার সঙ্গে পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী উপস্থিত ছিলেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, আগুনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে ৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা ও ঘর তৈরির টিন এবং তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। সেসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের শুকনো খবারও দেওয়া হবে।তিনি বলেন, বস্তির বাসিন্দারা রাজধানীর অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে অবৈধ গ্যাস বিদ্যুতের সংযোগ রয়েছে ঠিকই। কিন্তু এগুলো নিয়মের মধ্যে আনতে হলে বস্তিগুলোর স্থায়ী সমাধান দরকার। নয়তো শুধু অবৈধ গ্যাস বিদ্যুৎ বন্ধ করলেই তা সমাধান হবে না। আমরা আগে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য কি কি করা যায়, তাই করছি। এরপর বস্তিগুলোকে স্থায়ী পরিকল্পনার মধ্যে আনতে সরকারেন সঙ্গে আলোচনা করা হবে। আগুনের ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ খাবার পায়নি। তবে স্থানীয় কাউন্সিল ক্ষতিগ্রস্তদের খাবারের ব্যবস্থার জন্য রান্না শুরু করেছে। তবে বস্তির বাসিন্দারা সিংগারা কলাসহ অন্য কিছু খেয়ে দিন পার করছেন। এদিকে পুড়ে যাওয়া ঘরগুলোর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন বাসিন্দারা। কোনো কিছু অক্ষত রয়েছে কিনা। কিন্তু কিছুই অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়নি।