আসলে কয়টি বাঘ হত্যা করেছেন ‘বাঘ হাবিব’!

আসলে কয়টি বাঘ হত্যা করেছেন ‘বাঘ হাবিব’!
বাগেরহাট প্রতিনিধি : বাগেরহাটের শরণখোলায় ৯ মামলার আসামি হাবিব হাওলাদার ওরফে বাঘ হাবিবকে গ্রেফতার করেছে থানা পুলিশ। শুক্রবার (২৮ মে) রাতে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।বিভিন্ন মাধ্যমে শোনা যায় গ্রেফতার হাবিব সুন্দরবনের ৭০টি বাঘ হত্যা করেছেন। হাবিব আসলে কয়টি বাঘ হত্যা করেছে; একজন মানুষের পক্ষে এত বাঘ হত্যা করা সম্ভব কিনা এমন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।বাঘ হাবিবের প্রতিবেশী সুন্দরবন সুরক্ষায় নিয়োজিত কমিউনিটি পেট্রোলিং গ্রুপের (সিপিজি) ভোলা টহল ফাঁড়ি ইউনিটের দলনেতা মো. খলিল জমাদ্দার বলেন, দুই বছর আগে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের লাঠিমারা এলাকায় বনের মধ্যে একটি বাঘকে মৃত ভেবে কাছে গেলে আক্রমণের শিকার হন হাবিব। ভাগ্যক্রমে বাঘের আক্রমণ থেকে বেঁচে যান হাবিব। এর পর থেকে এলাকার মানুষ তাকে বাঘ হাবিব বলে ডাকেন।তিনি আরও বলেন, হাবিব একটু হাবাগোবা ধরনের মানুষ। ও আমার প্রতিবেশী। লোভে পড়ে সে বেশকিছু বন্যপ্রাণি শিকার করেছে। আসলে বনের মধ্য থেকে বাঘ হত্যা খুবই কঠিন কাজ। হাবিবকে আমি অনেকবার বুঝিয়েছি যে বনের কোনো প্রাণি শিকার করা যাবে না। এরা আমাদের সম্পদ। এসব কথার মাঝে হাবিব একদিন আমাকে বলেছে সে ৩২টি বাঘ হত্যা করেছে। এর মধ্যে ১৯টি বাঘিনী। কিন্তু এসব বাঘ হত্যা করে কি করেছে তার কিছু বলেনি সে।বাঘ শিকারি হাবিবের নেপথ্যে যারা জড়িত রয়েছেন তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে ‘সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনে’র চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের বন্যপ্রাণি নিধন ও বনকে সুরক্ষিত রাখতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তিনি দাবি করেন তাহলেই বন্যপ্রাণি নিধন কমে আসবে।তিনি বলেন, সুন্দরবন কেন্দ্রিক বিভিন্ন অপরাধে মাঝে মাঝে এ ধরনের হাবিবরা আইনের আওতায় আসে। আবার একটি নির্দিষ্ট সময় পরে আইনগতভাবেই মুক্তি পায় তারা। কিন্তু হাবিব বা স্থানীয় অপরাধীরা কাদের স্বার্থে দীর্ঘদিন ধরে বাঘ-হরিণসহ বন্যপ্রাণি হত্যা করছে তা এখনও অজানা।  বাঘের চামড়া, হাড়-গোড়, দাঁতসহ বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গ চড়া দামে বিক্রি হয়। এগুলো দেশের বাইরে পাচার হয়। হাবিবরা তো সুন্দরবন থেকে বাঘ মেরে-ই শেষ। কিন্তু যাদের মাধ্যমে হাবিবরা বাঘ হত্যায় উৎসাহ পাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ রয়েছে বলে আমার জানা নেই। যেকোন মূল্যে এদের খুঁজে বের করার দাবি জানান তিনি।গত শুক্রবার রাতে বন অপরাধে করা কয়েকটি মামলার আসামি সুন্দরবন সংলগ্ন শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের হাবিব তালুকদার (৫০) ওরফে বাঘ হাবিবকে গ্রেফতার করে পুলিশ।গ্রেফতারের পরেই আলোচনায় আসে বাঘ হাবিবের অপরাধ কর্মকাণ্ড। বন বিভাগ ও থানা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী বাঘ হাবিবের নামে নয়টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে বাঘ হত্যার দায়ে তিনটি, হরিণ হত্যার দায়ে পাঁচটি এবং বন অপরাধে আরও একটি। এসব মামলার মধ্যে তিনটি মামলায় ওয়ারেন্ট ছিল হাবিবের নামে। হাবিব গ্রেফতার হওয়ার পরেই এলাকায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আসলে কতটি বাঘ হত্যা করেছে হাবিব এ বিষয়ে কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেনি।তবে বন বিভাগের দাবি সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বন্যপ্রাণি হত্যা ও পাচারের সঙ্গে জড়িত হাবিবের গডফাদারদের খুঁজে বের করতে বন বিভাগের ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।সোনাতলা গ্রামের ইউপি সদস্য ডালিম হোসেন বলেন, গেল ১০ বছর আমি ইউপি সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমার জানামতে হাবিব সুন্দরবনের বন্যপ্রাণি শিকারি। দীর্ঘদিন ধরে হরিণ শিকার করে এলাকার প্রভাবশালীদের কাছে বিক্রি করে আসছে। তার ছেলে হাসান হাওলাদার ও মেয়ের জামাতা মিরাজ ঘরামী এই শিকারের সঙ্গে জড়িত। তবে দুই এক বছর ধরে শুনছি হাবিব বাঘও হত্যা করেছে। তবে কয়টি বাঘ হত্যা করেছে তা স্পষ্ট করে বলতে পারি না। পুলিশ তাকে ধরার জন্য আমার সহযোগিতাও চেয়েছে। অনেকদিন ধরে হাবিব এলাকা ছাড়া ছিল। মাঝে মধ্যে গোপনে আসত।শরণখোলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাইদুর রহমান বলেন, বাঘ হাবিবের নামে শরণখোলা থানায় তিনটি ওয়ারেন্ট মুলতবি ছিল। তাকে দীর্ঘদিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে সোর্সের মাধ্যমে তার অবস্থান শনাক্ত করে গ্রেফতার করে শনিবার (৩০ মে) দুপুরে আদালতের মাধ্যমে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে।সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মাদ বেলায়েত হোসেন বলেন, হাবিব আসলে কতটি বাঘ হত্যা করেছে তা আমাদের জানা নেই। হাবিবের নামে তিনটি বাঘ হত্যার মামলা রয়েছে। মামলার পরেই সুন্দরবনে হাবিবের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। হাবিবের মত যারা সুন্দরবনের বন্যপ্রাণি হত্যার সঙ্গে জড়িত রয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য আমাদের জোর প্রচেষ্টা চলছে।তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বাঘের প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রতঙ্গের উচ্চ মূল্য রয়েছে। যার ফলে একটি আন্তর্জাতিক চক্র বাঘের চামড়াসহ বিভিন্ন অঙ্গ পাচার ও ক্রয় বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। কয়েকটি হাত বদল হয়ে এসব অঙ্গ প্রতঙ্গ যায় বিদেশে। এই চক্রটি স্থানীয় প্রভাবশালীদের মাধ্যমে বাসিন্দা ও সুন্দরবনের জেলেদের ব্যবহার করে থাকে। এজন্য মূল হোতাদের শনাক্ত করা অনেক দূরূহ ব্যাপার। তারপরও বন বিভাগের ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের মাধ্যমে অপরাধীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।কে এই হাবিব? বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা-চরগ্রামের বাসিন্দা কদম আলী হাওলাদারের ছেলে হাবিব। বাবা জেলে থাকায় ছোটবেলা থেকে সুন্দরবনে ছিল তার যাতায়াত। বাবার মত হাবিবও সুন্দরবনে জেলে হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু একপর্যায়ে জড়িয়ে পড়েন বন্যপ্রাণি শিকার চক্রের সঙ্গে। নিজেই হরিণ শিকার শুরু করেন। এলাকায় প্রভাবশালীদের কাছে হরিণের মাংস বিক্রি করতেন তিনি। কথিত রয়েছে বাঘ পাচারকারী চক্রের সঙ্গেও তার যোগাযোগ রয়েছে। তিনি বাঘও হত্যা করেছেন।এসবের পরেও হাবিবের ভাগ্য বদল হয়নি। আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হয়নি তার। সরকারি জমি বন্দোবস্ত নিয়ে টিনের ঘর নির্মাণ করে বসবাস করেন তিনি। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে তার। এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে বন্যপ্রাণি শিকার করলেও তার আর্থিক পরিবর্তন হয়নি। এখনও দিন আনে দিন খায় হাবিব।বাগেরহাট আদালতের হাজতখানায় কথা হয় হাবিবের সঙ্গে। হাবিব বলেন, ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে সুন্দরবনে যেতাম। মাছ ধরতাম। অন্য কোনো আয়ের ব্যবস্থা না থাকায় আমরা সবাই বনের উপর নির্ভরশীল ছিলাম। একপর্যায়ে হরিণ শিকার করে স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে মাংস বিক্রি শুরু করি। কয়েক বছর এ কাজ করার পরে আইনের ভয়ে আর শিকার করি নাই।তিনি আরও বলেন, আমাদের এলাকায় আরও ২০-২৫টি পার্টি রয়েছে, যারা বন্যপ্রাণি শিকার করে। আমাকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসিয়েছে তারা। এছাড়া যারা প্রকৃত পক্ষে শিকারের সঙ্গে জড়িত তাদের আত্মীয়দের সঙ্গে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলেও দাবি করেন হাবিব।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

দুর্ঘটনার আশঙ্কায় জনমনে উদ্বগে বীরগঞ্জের সড়কগুলো দাপিয়ে বড়োচ্ছে কিশোর চালকরা

সন্দ্বীপে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা উদ্বোধন