কলকাতা: বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ সরাসরি পশ্চিমবঙ্গের ভূপৃষ্ঠে আছড়ে না পড়লেও ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলেছে রাজ্যটিতে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ইয়াসের সঙ্গে পূর্ণিমা এবং চন্দ্রগ্রহণ না থাকলে ঘূর্ণিঝড়ের এতটা প্রভাব পড়তো না রাজ্যে।সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ১৩৪টির মতো বাঁধের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে একাধিক বাঁধ ভেঙে পানির তলায় চলে গেছে গ্রামের পর গ্রাম।৬ লাখের মতো কাঁচাবাড়ির সলিল সমাধি হয়েছে। এমনকী মাছের ভেড়ি এবং চাষের জমিতে নোনাপানি প্রবেশ করে গ্রামগুলোর চাষের মাছ, ফসলের জমি, ধান-শস্য-সবজি নষ্ট করে দিয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বাঁধ, নদীর উপরে তৈরি ব্রিজ, সমুদ্র সৈকতের দোকান, হোটেল, রিসোর্ট। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে ক্ষতি হয়েছে ১৫ হাজার কোটি রুপির সম্পদের।আরও কী কী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা শুক্রবার (২৮ মে) পরিদর্শন করেন মুখ্যমন্ত্রী। বিশেষ করে ঝড়ের প্রভাব পড়েছে দুই ২৪পরগণা এবং পূর্ব মেদিনীপুরে। মমতা প্রশাসনিক বৈঠকে বলেন, গতবার আম্পান এবার ইয়াস সব নষ্ট করে দিয়েছে। ‘আমি টাকাগুলো কি জলে দিচ্ছি, নাকি জল সব টাকা নিয়ে নিচ্ছে?’ অপরদিকে ক্ষয়ক্ষতি দেখার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী এদিনই উড়িষ্যা হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আসেন। এ বিষয়ে দুপুরের পর মেদিনীপুরের কলাইকুন্ডলায় মমতা-মোদীর বৈঠক হয়।বিজ্ঞানীদের মতে, প্রসাশন যদি তাদের কথা মেনে চলতো তাহলে বছর বছর এত ক্ষতির মুখ দেখতে হতো না।তাদের মতে, নদীমাতৃক রাজ্য হওয়ার কারণে ক্ষয়ক্ষতি কমবেশি হতেই থাকবে। আর এর অন্যতম কারণ বালিয়াড়ি আর ম্যানগ্রোভ অঞ্চল নষ্ট করা। এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা একযুগ আগেই সাবধান করেছিলেন।তারা জানিয়েছিলেন, বালিয়াড়ি ভেঙে একের পর এক হোটেল তৈরি, ম্যানগ্রোভ অঞ্চল নষ্ট না করে একটু নিয়ম মানলে প্রকৃতির এরকম রোষানলে পড়তে হতো না।একই বিষয় সুন্দরবনের ক্ষেত্রেও। শুধু কৃত্রিম বাঁধ দিয়ে যে বিপদ ঠেকানো যাবে না, সেটা প্রমাণিত হয়ে চলেছে বারেবারে। নদীতে বাঁধ দেওয়ার নামে ম্যানগ্রোভ অঞ্চল নষ্ট করা এর অন্যতম প্রধান কারণ। মাটির বাঁধের পাশে ম্যানগ্রোভ গাছ রোপণ করলে তার শিকড় মাটিকে ধুয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।ওসব এলাকার বাসিন্দারা বলেছেন, তারা নিজেরাই আম্পানের পরে বাঁধে গাছ লাগিয়েছিলেন। পরে সেচ দফতর বাঁধ তৈরির নামে সেই সব গাছ নষ্ট করে দেয়। আর সে কারণে এই ধরনের বিপদ বারে বারে ঘুরে আসছে। এ বিপদ থেকে বাঁচতে হলে বনসৃজনে জোর দিতেই হবে। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভই পশ্চিমবঙ্গের বিপদ ঠেকানোর সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। কিন্তু সেকথা কানেই তুলছে না প্রশাসন। এমনটাই মনে করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বিজ্ঞানী সোমনাথ ভট্টাচার্যর মতে, রাজ্যের উপকূল এলাকায় এমন আশঙ্কার কথা আগেই বলা হয়েছিল। এই বিপর্যয় কিন্তু শেষ বিপর্যয় নয়। ভবিষ্যতে এমন বিপদ আরও আসবে। তিনি জানান, দিঘাসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় প্রাকৃতিক বালিয়াড়ি ছিল। জলোচ্ছ্বাস, ঝড়ের হাত থেকে বাঁচতে সেই বালিয়াড়ি ছিল রক্ষাকবচ। সেগুলো ধ্বংস করার খেসারত দিতে হচ্ছে এখন।একই বিপদের কথা জানিয়েছিলেন নদী বিজ্ঞানী কল্যাণ রুদ্রও। তিনি জানান, বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং সাগরের পানিস্তর বৃদ্ধি এখন গোটা পৃথিবীর সমস্যা। বঙ্গোপসাগর এবং সুন্দরবনে এর প্রভাব সবথেকে বেশি। একদিকে পানিস্তর বাড়ছে, অন্যদিকে বদ্বীপ বসে যাচ্ছে। পাশাপাশি সাগরের উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হচ্ছে ঘনঘন ঘূর্ণিঝড়। এই অবস্থায় লাগাতার প্রকৃতির অঙ্গহানির খেসারত দিতে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গকে। এখনও সচেতন না হলে আগামদিনে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে।