দেশের বিমানবন্দরগুলোতে বেপরোয়া মাদক মাফিয়ারা

দেশের বিমানবন্দরগুলোতে বেপরোয়া মাদক মাফিয়ারা

সমাচার রিপোর্ট : দেশি-বিদেশি মাদক মাফিয়ারা দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোকে নিরাপদ রুট হিসাবে ব্যবহার করছে। সেজন্য তারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়াও মাফিয়ারা সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও মাদক পাচারে ব্যবহার করছে। ইতিমধ্যে রপ্তানি পণ্যের আড়ালে একাধিক মাদকের চালান ধরা পড়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই তা বন্ধ হচ্ছে না। বরং মাদক চালান ধরার পর কিছুদিন বিরতি দিয়ে মাদক চোরাচালানিরা ফের সক্রিয় হয়ে উঠে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অসাধু সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট (কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং), ব্যবসায়ী এবং বিমানবন্দরের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িতদের ব্যবহার করেই বিমানবন্দর দিয়ে নির্বিঘ্নে পাচার হচ্ছে মাদকের বড় বড় চালান। বিভিন্ন সময়ে গেস্খফতারকৃত কাছ থেকে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানতে পারে। বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টরা মাদকের চোরাচালান ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রহস্যজনকভাবে নিরব থাকারও অভিযোগ রয়েছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি সুরক্ষা ইউনিটের মালামাল কার্টনের ভেতর থেকে প্রায় ৩৯ হাজার ইয়াবা জব্দ করা হয়। যা কার্গো বিমানে সৌদি আরবে যাওয়ার কথা ছিল। ওই ঘটনায় মামলা হয় এবং ডিএনসি ইতিমধ্যে ৫ জনকে গ্রেফতার করে। তাছাড়া ওই মাদক পাচার সিন্ডিকেটটির অন্যতম মাস্টারমাইন্ডসহ আরো ৭ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা বিমানবন্দরে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ব্যবসার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।
সূত্র জানায়, মাদক পাচার রোধে বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় সিভিল এভিয়েশন অথরিটির আরো ১২টি টু ডি স্ক্যানার কেনার কথা ছিল। কিন্তু ওসব স্ক্যানার বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় যুক্ত হয়নি। বরং সিভিল এভিয়েশন অথরিটি পণ্য তল্লাশি কিংবা স্ক্যানিংয়ের বিষয়ে কাস্টমস, ডাক বিভাগ, ডিএনসির ভূমিকার বিষয়টি তুলে ধরছে। সিভিল এভিয়েশন অথরিটির মতে, ফ্লাইটে কোনো ধরনের থ্রেট আছে কিনা তাই মূলত দেখভাল করার দায়িত্ব সিভিল এভিয়েশন অথরিটির। কিন্তু কার্গোতে কী রয়েছে তা দেখার জন্য বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। ইতিমধ্যে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি ১২টি টু ডি স্ক্যানার কিনেছে এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থা জাইকার ৩০০টি অত্যাধুনিক ক্যামেরা দেয়ার কথা রয়েছে। ওসব ক্যামেরা সংযোজিত হলে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা আরো জোরদার হবে।
সূত্র আরো জানায়, গত ১৯ মে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাষ্ট্রীয় ডাক বিভাগের একটি ব্যাগে ২ হাজার ৩৫৫ পিস ইয়াবা পাওয়া গেছে। ওই ঘটনায় ডাক বিভাগের ৫ কর্মচারীকে আটক করা হয়েছে। বিমানবন্দরের ৮ নম্বর হ্যাঙ্গার গেটে পোস্ট অফিসের মালামাল স্ক্যানিংকালে একটি ব্যাগের ভেতর ইয়াবাগুলো পাওয়া যায়। তাছাড়া গত ২২ মার্চ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বহির্গমন টার্মিনাল থেকে তেঁতুলের আচারের দুটি বয়ামে ৯ হাজার ৮৮৫ পিস ইয়াবাসহ এক যাত্রীকে আটক করে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ। গত ১৩ মার্চ দিবাগত রাতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পেটের মধ্যে বিশেষ কায়দায় ৭ হাজার ৯৯০ পিস ইয়াবাসহ দুজনকে গ্রেফতার করে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ (এপিবিএন)। গ্রেফতার দুজন কক্সবাজার থেকে নভোএয়ারের ফ্লাইটে ঢাকা এসেছিল এবং বিমানবন্দরের স্ক্যানিংয়ে তারা ধরা পড়ে। এপিবিএনের সদস্যদের জেরার মুখে তারা পেটের ভিতর ইয়াবা থাকার কথা স্বীকার করে। প্রায় ১২ ঘণ্টা পর তাদের পেট থেকে ১৬০ প্যাকেট ইয়াবা বের করে আনা হয়। তাদের কাছ থেকে ৭ হাজার ৯৯০ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। যার বাজারমূল্য ৪০ লাখ টাকা। তাছাড়া গত ৩০ জানুয়ারি কক্সবাজার থেকে পাকস্থলীতে করে ২ হাজার ৮০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট আনার সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক ব্যক্তিকে আটক করে আর্মড পুলিশ। গত ২০১৯ সালের নভেম্বরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মালয়েশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে সিডোঅ্যাফিড্রিন পাঠানো হচ্ছিল। চালানটি মালয়েশিয়ায় ধরা পড়ে। অপর দুটি চালানের একটি হংকং হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাম্ফিটামিন যাচ্ছিল। ইয়াবা যাচ্ছিল সৌদি আরবে। সবকটিই তৈরি পোশাক রপ্তানির ঘোষণা দিয়ে মাদক পাচারের চেষ্টা করা হয়েছিল। গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে এভিয়েশন সিকিউরিটির সদস্যরা ইয়াবা তৈরির উপকরণ অ্যাম্ফিটামিন উদ্ধার করে। ওই ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়েছে। পাচারকারীরা মূলত তৈরি পোশাক পণ্যের আড়ালে ১২ কেজি ৩২০ গ্রাম সাদা রঙের অ্যাম্ফিটামিন পাচারের চেষ্টা করেছিল। পাচারকারীরা বাংলাদেশি ও ভারতীয় বলে জানা যায়।
এদিকে পুলিশ ও ডিএনসি সংশ্লিষ্টদের মতে, শাহজালাল বিমানবন্দর মাদক পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে এমন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সেজন্য মূলত লাগেজে পণ্য পরিবহনের সময় স্ক্যানিং ঠিকমতো না হওয়া দায়ী। প্রথমে মাদক তৈরির কাঁচামাল সিডোঅ্যাফিড্রিন পাচার এবং পরে অ্যাম্ফিটামিন ও ইয়াবার চালান আটকের পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেরাই এসব কথা বলছে। পাচারকৃত মাদকের গন্তব্য প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। গত ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত মাদক পাচারের ঘটনায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ৩টি চক্রকে শনাক্ত করেছে। ওসব চক্রে ৫০ থেকে ৬০ জন আছে। তাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের সাবেক একজন এমপি, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কর্মী, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতীয় পাসপোর্টধারী নাগরিক, নামসর্বস্ব ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, মিটফোর্ডকেন্দ্রিক ও ভারতীয় কয়েকজন ওষুধ বিক্রেতাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) মহাপরিচালক মুহাম্মদ আহসানুল জব্বার জানান, কিছুদিন আগেই মাদক পাচারে পোস্টালের লোকজন জড়িত থাকার বিষয়টি পোস্টালের ডিজিকে অবহিত করা হয়। শাহজালাল বিমানবন্দরকে যাতে কোনোভাবেই মাদকের রুট হিসেবে কেউ ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে ডিএনসি কাজ করে যাচ্ছে। তবে এয়ারপোর্টে ডিএনসির সদস্যরা যারা দায়িত্ব পালন করে তাদের বিশ্রামের জন্য একটু জায়গা বরাদ্দ দেয়ার জন্য সেখানকার কর্তৃপক্ষকে দফায় দফায় বলা হলেও ইতিবাচক সাড়া মিলছে না। তাছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিএনসি ডগ স্কোয়াডের বিষয়ে ভাবছে। সেজন্য ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে চিঠিও লেখা হয়েছে। ডগ স্কোয়াডের অনুমতি পেলে মাদক নিয়ন্ত্রণে আরো ভূমিকা রাখতে পারবে ডিএনসি। আগে বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিস দিয়ে মাদক পাচার করা হলেও এখন সরকারি ডাক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। আর তা রোধে ডিএনসির সদস্যরাও বসে নেই।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

দুর্ঘটনার আশঙ্কায় জনমনে উদ্বগে বীরগঞ্জের সড়কগুলো দাপিয়ে বড়োচ্ছে কিশোর চালকরা

সন্দ্বীপে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা উদ্বোধন