নিজস্ব প্রতিবেদক : মহামারি করোনাকালে মানবতার সেবায় এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে অদম্য সাহস আর মানবতার সেবাকে পুঁজি করে একদল তরুণের গড়ে তোলা ‘মেহমান খানা’। গতবছর রোজায় যাত্রা শুরু হয় এই মেহমান খানার।এবারও রোজার প্রথম দিন থেকেই চলছে কার্যক্রম।রাজধানীর লালমাটিয়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিন ইফতারের সময় বাড়তে থাকে মেহমানদের সংখ্যা। এখানে আসা বেশিরভাগ মেহমান সমাজের খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ। এদের মধ্যে কেউ রিকশাচালক, কেউ দিনমজুর, কেউ ফল বিক্রেতা আবার কেউ আশেপাশের কোনো বাসাবাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী। তবে এখানে আসার পর তাদের একটাই পরিচয় তারা মেহমান খানার মেহমান।ইফতারের সময় দেখা যায়, লালমাটিয়া এলাকার রাস্তার দুইপাশের সারি সারি রিকশার লাইন। মেহমান খানার স্বেচ্ছাসেবকেরা একে একে তাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন ইফতারের জন্য শরবত, পানীয় এবং রান্না করা খাবার। মেহমানরাও সুশৃঙ্খলভাবে খাবার নিচ্ছেন।এছাড়াও যারা বাসায় নিয়ে যেতে চান তাদেরও চাহিদামতো খাবার সরাবরাহ করা হয়। বাসায় খাবার নিয়ে যাওয়ার বিষয়েও নেই কোনো বিধিনিষেধ। দুজন-তিনজন বা তার অধিক লোকের জন্য খাবার চাইলেও স্বেচ্ছাসেবকেরা খাবার দেন।মেহমান খানার স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন প্রায় ১১শ থেকে ১২শ লোক তাদের মেহমান খানার খাবার খান। মাঝে মাঝে দেখা যায়, যে পরিমাণ খাবারের আয়োজন করা হয়েছে মেহমান তার থেকে বেশি চলে এসেছে। তখন তাদের জন্য ছোলা-মুড়ি-খেজুর বা অন্য কোনো খাবার সরবরাহ করা হয়। তাতেও না হলে মেহমানরা নিজেরাই নিজেদের খাবার হাসিমুখেই কয়েকজন ভাগ করে খেয়ে নেন।প্রতিদিন ইফতারের আগে হ্যান্ড মাইক দিয়ে লালমাটিয়া এলাকায় মাইকিং করা হয়।ইফতারের সময় এখানে খাবার গ্রহণ করা রায়ের বাজার এলাকার জাফর নামক একজন রিকশাচালক বলেন, গরিব মানুষের জন্য এমন আয়োজন করায় আমরা খুশি। এখানে একসঙ্গে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ইফতার করে। আল্লাহ যেন তাদের আরও মানুষদের সেবা করার সুযোগ দেয়, সেই দোয়া করি।নূর ইসলাম নামের আরেকজন বলেন, আমার পরিবারে আর কেউ নেই। আমার মতো অসহায় মানুষদের যারা খাওয়াচ্ছে তাদের জন্য আমি মন থেকে দোয়া করি, তারা যেন এমন ভালো কাজ আরও বেশি বেশি করতে পারে।মেহমান খানার আয়োজকদের অন্যতম একজন লিজা আছমা আকতার। এমন উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গতবছর যখন লকডাউন শুরু হয়, তখন সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হয়, তখন আমরা ভাবি যারা পথের মানুষ তারা কি করবে, কোথায় যাবে, কি খাবে? সেই চিন্তা থেকে আমরা প্রথমে আশপাশের নিরাপত্তা প্রহরী, কিংবা পথশিশু যারা রয়েছে তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করি। সেই থেকে আমাদের মেহমান খানার যাত্রা শুরু। বর্তমানে আমাদের মেহমান খানায় প্রায় ১১শ থেকে ১২শ লোক খাবার খায়। এই করোনাকালে মানুষ এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই আমাদের এই উদ্যোগ।আয়োজকরা জানান, এখানে প্রতিদিন প্রায় ১৭ জন থেকে ২৫ জনের মতো স্বেচ্ছাসেবক শ্রম দেন। এসব স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে এমন মানুষও রয়েছেন যিনি স্কুল শিক্ষিকা, স্কুল বন্ধ থাকায় এই সময়টা তিনি এখানে মানুষের সেবা করছেন। আবার এমন স্বেছাসেবকও রয়েছেন যিনি ঢাকায় রাইড শেয়ার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।আয়োজকদের আরও একজন হচ্ছেন, সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন। তিনি বলেন, করোনার বিরুদ্ধে সবাইকে একসঙ্গে লড়াই করে জিততে হবে। এই লড়াই একা জেতার লড়াই না, তাই আমরা সবাই মিলে মানুষের জন্য কিছু করতে চাই। এই তাড়না থেকে মেহমান খানার যাত্রা শুরু।তিনি আরও বলেন, এইখানে যারা আসেন খাবার খেতে তাদের পরিচয় একটাই তারা আমাদের মেহমান। মেহমান খানার অর্থের যোগান কীভাবে হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে আমরা ব্যক্তি উদ্যোগে টাকা দিয়ে মেহমান খানা চালু করি। তবে বর্তমানে আমাদের অনেক বন্ধু-বান্ধব, এবং সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বেশ কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী আমাদের বিভিন্ন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করেন। এসব সাহায্য সহযোগিতা দিয়েই আমাদের মেহমান খানার কার্যক্রম চলছে।