মোস্তাকিম ফারুকী : ওয়ারী বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর গড়ে ওঠা আদি ঢাকা শহরের প্রথম পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। ঢাকার বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান বলধা গার্ডেনও ওয়ারীতে অবস্থিত। ১৮৮৪ সালে ঢাকার রাজস্ব প্রশাসক বা ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর ছিলেন ফ্রেডরিক ওয়্যার। তিনি জনবসতি স্থাপনের লক্ষ্যে পুরো এলাকাটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করে উন্নয়ন শুরু করেন। তার উদ্যোগে জঙ্গল কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়। এসব ছিল লাল সুড়কি বিছানো পথ। এছাড়া রাস্তার দুপাশে তৈরি করা হয় ড্রেন। তৈরি করা হয় পানি সরবরাহের জন্য ওভারজহড পানির ট্যাংক বা রিজার্ভার। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে ফ্রেডারিক ওয়্যারের নাম অনুসারেই এ আবাসিক এলাকাটির নামকরণ হয়েছিল ওয়ারী। প্রথমত সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে বিনামূল্যে আবাসিক প্লট বরাদ্দ করা হয় তবে শর্ত দেয়া হয় যে তিন বছরের মধ্যে বসত বাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করতে হবে। বাড়ীর নকশা অনুমোদন করিয়ে নেয়ার শর্তও যুক্ত ছিল। প্রতি ভিটার খাজনা ধরা হয় ছয় টাকা। যেহেতু অধিকাংশ সরকারি চাকুরে ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী তাই ওয়ারী হিন্দু-প্রধান এলাকা হিসেবে গড়ে উঠেছিল। সে সময় ওয়ারী ছিল সবুজ নিবিড় একটি চমৎকার আবাসিক এলাকা। তৎকালীন ঢাকার সুন্দর ছিমছাম নিরিবিলি একটি আবাসিক এলাকা হয়ে উঠেছিল ওয়ারী। অধিকাংশই ছিল এক তলা বাড়ী, দুয়েকটি দোতলা। প্রায় প্রতিটি বাড়ী সম্মুখভাগে একটি ফুল বাগান, ভেতরাংশে উঠোন। এখানে-ওখানে পুকুর, সুপরিসর খেলার মাঠ, এসবও ছিল।
কিন্তু বর্তমানে সেই ঐতিহাসিক পরিকল্পিত নগরী চিত্র সম্পুর্ন ভিন্ন। ওয়ারীকে এখন আর শুধু আবাসিক এলাকা বলা যাবে না। এখানে বিগত এক দশকে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু অভিজাত বিপণি বিতান। আগে যেগুলো ছিল, তার পরিসর আরও বাড়ছে। আড়ং, নবরূপা, রূপসী বাংলা, বৈশাখী, আবর্তন, ক্যাটস আই, ইয়েলো প্রভৃতি দোকানে উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের যাতায়াত বেশি। রাস্তার পাশেও গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছোট ছোট দোকান।মূলত র?্যাংকিন স্ট্রিট, হেয়ার স্ট্রিটে এসব প্রতিষ্ঠানের অবস্থান।
অত্র এলাকার বাসিন্দা আরাফাত হাবিবের সাথে কথা বললে তিনি জানান, ওয়ারীতে এখন আর প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেওয়া যায় না। বাসা থেকে নিচে নামলেই যানজট এমনকি বাসার সিঁড়ির সামনেও পার্কিং করা থাকে গাড়ী।
লক্ষ্য করে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি বিল্ডিংয়ের নিচতলায়ই গড়ে উঠেছে মার্কেট যার উপর তলায় জনবসতি।
প্রতিটি চৌরাস্তা যানচলাচল বেপরোয়া, নেই কোন ট্রাফিক সিগনাল। যেগুলোতে প্রতিদিনই ছোট-বড়, কোন না কোন দূর্ঘটনা ঘটেই থাকে।
স্কুল ব্যাগ হাতে নিয়ে এক বাচ্চা ও তার অভিভাবক পথচারীর সাথে আলাপ করলে তিনি জানান, বাসা থেকে বাচ্চাদের নিয়ে একটু নিচে নামতে পারি না, যেতে পারি না নিরাপদে বাচ্চাদের স্কুল কিংবা কোচিং-এ সময় মত। সবসময় এখানে যানজট লেগেই থাকে।
প্রতিটি রাস্তার দৃশ্য প্রায় একই, নিচে যানবাহনের যানজট আর উপরে ঝুলন্ত ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ ও ডিসের তারের যানজট। এমন অবস্থার প্রতিকার এলাকার প্রতিটি মানুষের প্রাণের দাবি।
বর্তমানে যানজটে আবদ্ধ এই এলাকা দেখে এখন বোঝা দুষ্কর যে একদিন ওয়ারী ছিল ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত আবাসিক এলাকা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশের ৪১ নং ওয়ার্ড ওয়ারী এলাকার কাউন্সিলর সারোয়ার হোসেন আলোর সাথে আলাপকালে তিনি জানান, ওয়ারীকে যানজট মুক্ত করতে ৬০ জন কমিউনিটি পুলিশ আমরা ইতিমধ্যে নিয়োগ দিয়েছি, যাদের কার্যক্রম রমজান মাস থেকে শুরু হবে। অতিরিক্ত দোকানপাটের ব্যাপারে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলছে। কিছুদিনের মধ্যে ভালো কোন সিদ্ধান্ত জানাতে পারব বলে আমরা আশাবাদী।