নিজস্ব প্রতিবেদক : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ছিল বৃহস্পতিবার। লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের ২৪তম দিবসটির ভোর থেকেই অসংখ্য মিছিল সারা শহর প্রদক্ষিণ করতে থাকে। আজকের মিছিলের চরিত্র ছিল ভিন্নরূপ। মিছিলকারী সকলের হাতেই ছিল নানারকম দেশী অস্ত্র। মূলত গতকাল থেকেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, আজ কিছু একটা ঘটবে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, গত ২২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রাক্তন বাঙালী সৈনিকদের সঙ্গে বৈঠকে কর্নেল ওসমানী সাহেব বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ডু ইউ থিংক দ্যাট টুমরো উইল বি এ ক্রুসিয়াল ডে?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেন, ‘নো, আই থিংক, ইট উইল বি টুয়েন্টি ফিফথ্।’ তখন ওসমানী সাহেব পুনরায় তীক্ষè স্বরে তাঁর কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘কাল তো তেইশে মার্চ। পাকিস্তান দিবস। সে উপলক্ষে ওরা কী কিছু করতে চাইবে না?’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ওরা যে কোন মুহূর্তে যে কোন কিছু করতে পারে। তার জন্য কোন দিবসের প্রয়োজন হয় না। আসলে আমরা যতটা এগিয়ে গিয়েছি এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে শঙ্কাও বোধ করছি। সে কারণে ওরাও কম শঙ্কিত নয়। ওরা জানে এডভান্স কিছু করার অর্থই সব শেষ করে দেয়া।’ কি নিখুঁত হিসাব বঙ্গবন্ধুর। হিসাব করেই তিনি বলেছিলেন, ২৫ মার্চই পাকিস্তানীরা ক্র্যাকডাউন করবে। কেননা ২৫ মার্চে ডাকা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় স্থগিত করার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং জনাব ভুট্টো এই দিনটিতেই বাঙালী নিধনে অপারেশন সার্চলাইট প্রণয়ন করে রেখেছিল। আজ এটা আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠল দুপুর ১২টায় যখন আমরা জানতে পারলাম, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাঁর দলবলসহ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে চলে গেছেন। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় আলোচনা করতে আসা সব রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দও ইতোমধ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। অর্থাৎ আলোচনা সম্পর্ণতই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। অথচ গতকালও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে প্রায় ৪৫ মিনিট বৈঠক করে মি. ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেছিলেন, কোয়ালিশন সরকার গঠনের কথা আর আজ তাদের সকল প্রস্তুতি হচ্ছে গণহত্যা সংঘটিত করা। এদিন সকাল ১১টায় সেনাবাহিনীর একটা হেলিকপ্টারে মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ এবং জেনারেল ওমর রংপুর গেলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে গণহত্যার প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করে উর্ধতন সামরিক অফিসারগণ রংপুর ত্যাগ করেন। রংপুর থেকে সোজা রাজশাহী, যশোর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট পরিদর্শন শেষে বিকেলে ঢাকা ফেরেন। এদিকে সর্বত্র চাউর হয়ে যায়, ইয়াহিয়ার প্রধান সাহায্যকারী উপদেষ্টা এম এম আহামদ গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে আমরা জানতে পারি, সকল সংবাদ মাধ্যমকে এড়িয়ে গোপনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া করাচীর উদ্দেশে যাত্রা করেন। এরপর ইয়াহিয়ার আরেক উপদেষ্টা এ কে ব্রোহীও ঢাকা ত্যাগ করেন। অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি থমথমে রূপ ধারণ করে। আলোচনার নামে কালক্ষেপণকারী কুচক্রী মহলের ষাড়যান্ত্রিক নীলনকশা বাস্তবায়নের ভয়াল রাত ক্রমেই এগিয়ে আসতে থাকে।
সকাল ৯টা থেকে আমি এবং মনি ভাই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নেতার সান্নিধ্যেই ছিলাম। আমরা একবার ৩২ নম্বরে নেতার বাসভবনে যাই আবার সেখান থেকে বেরিয়ে তার নির্দেশ মতো কাজ করে আবার ৩২ নম্বরে আসি। এর মধ্যে একের পর এক মিছিল আসতে থাকে। মিছিলকারীদের উদ্দেশে ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে সতর্ক থেকে সকলের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু একই কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। অচিরেই আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সর্বাÍক এক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হতে পারে এবং সেই যুদ্ধ আজ থেকে শুরু হলে অবাক হওয়ার কিছুই নাই। জনতার দাবিকে শক্তির দাপটে দাবিয়ে রাখার জন্য যদি কেউ রক্তচক্ষু প্রদর্শন করে আমরা তা বরদাস্ত করব না। যে কোন ধরনের ষড়যন্ত্র আমরা নিশ্চিহ্ন করে দেব।’ দুপুর ১২টায় দলবলসহ ইয়াহিয়ার ক্যান্টনমেন্টে চলে যাওয়ার খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এএইচএম কামারুজ্জামান, শেখ আব্দুল আজিজ, আব্দুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, গাজী গোলাম মোস্তফা, খাজা আহমদ, মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী, আব্দুস সামাদ আজাদ, মতিউর রহমান, মশিউর রহমান, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখনসহ অন্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং আমাদের স্ব-স্ব দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রত্যেককে নিজ নিজ জেলা ও এলাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক তৎপরতা পরিচালনার নির্দেশ দেন। তখন নেতৃবৃন্দের প্রত্যেকেই নেতার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘আপনি আমাদের বিদায় করছেন। কিন্তু আপনি কী করবেন? আপনি কোথায় যাবেন?’ তখন তিনি উপস্থিত নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি জানি আজই তারা ক্র্যাকডাউন করবে। তবুও আমি এখানেই থাকব। কারণ, ওরা যদি আমাকে না পায়, তাহলে ঢাকা শহরকে ওরা ধ্বংসস্তপে পরিণত করবে। আর তাছাড়া আমি নীতিগতভাবে মনে করি, আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নির্বাচিত নেতা আমার পক্ষে পলায়ন করা সম্ভবপর নয়। এ ছাড়াও চতুর্দিকে কমান্ডো আছে আমি যদি কোথাও যেতে চাই তাহলে ওরা আমাকে হত্যা করবে। আমি তো আমার জীবন দেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছি। আজ আমার জীবন সার্থক। আমি যা চেয়েছিলাম তাই পেয়েছি। আজ একটা সফল ধর্মঘট পালিত হয়েছে। বাংলার মানুষ আজ তাদের নির্বাচিত নেতার নির্দেশেই পরিচালিত হচ্ছে। এই তো প্রথম বাঙালীরা যে একদিন তাদের ভাগ্যনিয়ন্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। আজকে বাঙালীরাই বাংলার ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হয়েছে।’ এর মধ্যে একজন বললেন, ‘ওরা তো আপনাকে হত্যা করবে।’ তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে হত্যা করে লাভ নাই। ওরা তো বার বার আমাকে কারাগারে নিয়েছে। আমাকে নির্যাতন করেছে। ওদের লাভ হয় নাই। আমাকে হত্যা করেও ওদের লাভ হবে না। কারণ আমার মতো লক্ষ মুজিবের জন্ম হবে বাংলাদেশে। আমি আজ তৃপ্ত। আমি যা চেয়েছি, আমি তা পেয়েছি। আমি জানি আমার স্বপ্ন পূরণ হবে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। যে বাংলার দামাল ছেলেরা রক্ত দিতে শিখেছে, যে বাংলার ছেলেরা জীবন দিতে শিখেছে, সেই বাঙালী জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আমাকে যদি হত্যা করে আর আমার মৃতদেহ যদি কেউ দেখে, দেখবে আমার মুখে হাসি। কারণ, আমি পরিতৃপ্ত। আমি যা চেয়েছি, আমি তা পেয়েছি।’ এ কথা বলে তিনি সবাইকে বিদায় জানান। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু সব সহকর্মীদের বিদায় দিয়ে সবশেষে ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে বিদায় দেন। রাত সাড়ে ১১টায় যখন আমি এবং মনি ভাই বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম। তখন তিনি বাসার বারান্দায় একা পায়চারী করছেন। আমাদের দেখে বুকে টেনে নিলেন, আদর করে বললেন, ‘তোমরা আবার এসেছ।’ আমার হাতে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বললেন, ‘আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি, যাও।’ কোথায় গেলে কি পাব সে সব সংক্ষেপে বলে আমাদের কপালে চুমু দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাদের দোয়া করি। আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই হবে। তোমাদের আমি যে দায়িত্ব দিয়েছি তা যথাযথভাবে পালন কর।’
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে শিল্পপতি জহিরুল ইসলাম সাহেব আমাকে একটা গাড়ি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর মনি ভাই সেই গাড়িতে করে রওনা দিই। রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে যখন যাই তখন সংগ্রামী জনতা রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছে। সেগুনবাগিচায় একটা প্রেসে স্বাধীনতার ঘোষণা সংবলিত লিফলেট ছিল। সেই লিফলেট নিয়ে যাব ফকিরাপুলে মনি ভাইয়ের বাসায়। প্রেস পর্যন্ত গেলাম, লিফলেট নিলাম। রাস্তায় ব্যারিকেড থাকার কারণে গাড়ি নিয়ে আর এগুনো গেল না। অগত্যা হেঁটেই রওনা দিলাম। এরপর রাত ১২টায় মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী শুরু করল ইতিহাসের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড। শুরু হলো বাঙালী নিধনযজ্ঞ তথা গণহত্যা। সে জন্যই ২৫ মার্চ বাঙালীর ইতিহাসের কালরাত্রি। নিরস্ত্র-নিরপরাধ বাঙালীর ওপর জঘন্য হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী পাকিস্তান রাষ্ট্রের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে। চারদিকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ। আর আমার কানে তখন কেবলই বাজছে বিদায় বেলায় বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশ, ‘তোমাদের যে দায়িত্ব আমি দিয়েছি, সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন কর। আমার জন্য ভেবো না। আমি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি, আমার স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই হবে। ওরা অত্যাচার করবে, নির্যাতন করবে। কিন্তু আমার বাংলাদেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’