নিজস্ব প্রতিবেদক : ২৪ মার্চ, ১৯৭১। অগ্নিঝরা মার্চের এই দিনে ক্ষোভে উত্তাল ঢাকাসহ সারাদেশ। একদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পরামর্শক দল প্রহসনের আলোচনা চালাচ্ছে, অন্যদিকে নির্বিচারে গণহত্যার জন্য ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সামরিক জান্তা। বাঙালী ভাবতেও পারেনি মাত্র একদিন পর তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ বিভীষিকাময় রাত।
২৫ মার্চ ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে পাক হানাদার বাহিনীরা। এদিকে আলোচনার নামে প্রহসনে ক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু পাক সামরিক জান্তার উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন, ‘আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই।
আগামীকালের মধ্যে সমস্যার কোন সমাধান না হলে বাঙালী নিজেদের পথ নিজেরা বেছে নেবে।’ চট্টগ্রামে যখন বাঙালীদের হত্যার জন্য অস্ত্র নামানো হচ্ছে, তখন ঢাকায় ইয়াহিয়ার পরামর্শকরা বৈঠক করছেন আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে। আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে সামরিক জান্তার পক্ষে আলোচনায় অংশ নেন এম এম আহম্মদ, বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান। সকালে ও সন্ধ্যায় দু’দফা বৈঠক চলে। বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের জানান, ইয়াহিয়ার কাছে দাবি জানালে কোন কাজ হবে বলে মনে হয় না। ‘বল এখন প্রেসিডেন্টের কোর্টে’ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
একাত্তরের এই দিন করাচী থেকে সোয়াত নামক একটি জাহাজ আসে। এতে ৫ হাজার ৬৩০ টন অস্ত্র আনা হয়। অস্ত্র নামাতে গিয়ে বাঙালী শ্রমিকরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাক হানাদার সামরিক অফিসারদের মুখের ওপর শ্রমিকরা অস্ত্র নামাতে অস্বীকৃতি জানায়। অবরোধ করে রাখে জাহাজটিকে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করে বেশ কয়েকজন স্বাধীনতাকামী শ্রমিক।
একাত্তরের এই দিনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ভবনে বিভিন্ন সময়ে সমাগত মিছিলকারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় বিরামহীনভাবে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। আগামীকালের মধ্যে সমস্যার কোন সমাধান না হলে বাঙালীরা নিজেদের পথ নিজেরা বেছে নেবে। আমরা সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ।
কোন ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলার জনগণের ওপর কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হলে তা বরদাশত করা হবে না।
একাত্তরের ২৪ মার্চ বুধবার থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা একে একে ঢাকা ত্যাগ করতে শুরু করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট পার্লামেন্টারি দলের সব নেতাই এ দিন কারাচীর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ভুট্টোর সফরসঙ্গী ১৩ জনের ৭ জনই এদিন ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৩ মার্চ রাত হতে ২৪ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসেরপার্শ্ববর্তী বোতলগাড়ি, গোলাহাট ও কুন্দুল গ্রাম ঘেরাও করে অবাঙালীদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে এক শ’ নিহত এবং এক হাজারেরও বেশি আহত হয়।
গত দিনের মতো এদিনও সারা বাংলাদেশে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল পতপত করে। ইস্ট বেঙ্গল পাকিস্তান রাইফেলসের যশোর ট্রাংক রোডের অফিসেও এদিন উড়ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এদিকে ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণে পাকিস্তান থেকে খান আবদুল কাইয়ুম খান ঢাকায় আসেন। কাইয়ুম ঢাকা আসার পরই ইয়াহিয়া এবং ভুট্টোর সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন।
বৈঠক শেষে জুলফিকার আলী ভুট্টো সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে তিনি সর্বদা নমনীয় ও আন্তরিক মনোভাব পোষণ করেন। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান বাস্তবিকই শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। কিন্তু এমন আলোচনার আড়ালে যে বিভীষিকাময় গণহত্যার ষড়যন্ত্র সামরিক জান্তা করছিল, তা বাঙালী জাতির কাছে ছিল ধারণারও বাইরে।