পূর্বাচলে ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট বরাদ্দের নামে রাজউকের শতকোটি টাকার বাণিজ্য

পূর্বাচলে ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট বরাদ্দের নামে রাজউকের শতকোটি টাকার বাণিজ্য

মোঃ আবু তালেব
রাজউক পূর্বাচল উপ-শহর প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে প্লট বরাদ্দে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাজউকের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারী প্লট বরাদ্দের নামে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ক্ষতিগ্রস্তরা এই তালিকা বাতিল করে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থদের নামে প্লট বরাদ্দ করে তা পুনরায় প্রকাশের জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। এরপর ধাপে ধাপে ওই এলাকায় জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। যাদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করা হয়, তাদের ক্ষতিপূরণ এবং প্লট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রাজউক। ইতোমধ্যে প্লট ও ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে। আবার পাননি এ রকম সংখ্যাও কম নয়। সর্বশেষ রাজউক সিদ্ধান্ত নেয়, যাদের ৩১ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে। এই ধাপে এসে প্লট বরাদ্দে অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা অর্থাৎ যারা রাজউকের কাছে জমি বিক্রি করেছিলেন বা রাজউক জমি অধিগ্রহণ করেছিল। এ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা। তারা বিভিন্ন আবেদন-নিবেদন করছেন রাজউক চেয়ারম্যানসহ পূর্তমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
তবে রাজউক কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্ষতিগ্রস্ত যারা অস্বচ্ছতার অভিযোগ তুলছেন, তাদের আবেদনে ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। ফলে তারা এখন পাচ্ছেন না। পরবর্তীতে তাদের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকেরই একজন পরিচালক বলেন, নামে মাত্র রাজউকের চেয়ারম্যান থাকলেও রাজউক নিয়ন্ত্রণ করে মূলত একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী পরিচালক। তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য পরিচয় দিয়ে একের পর এক প্রতারণা ও দুর্নীতি করে চলেছেন। কার্যত: তার ইশারায়ই চলছে রাজউক। পূর্বাচলের ক্ষতিগ্রস্তরা প্লট বরাদ্দ থেকে বাদ পড়ার পেছনেও রয়েছে তার হাত। পূর্বাচলের ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট বরাদ্দ নিয়ে এ পর্যন্ত কয়েশ’ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। তিনি আরো বলেন, শেখ শাহীন নামের ওই পরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একাধিক অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে তদন্ত শুরু হয়েছে।
ব্যারিস্টার আক্তারুজ্জামান সমাচারকে বলেন, অতীতে ক্ষতিগ্রস্ত ও আদিবাসী কোটায় ৬ হাজার ৪২৪টি প্লট পূর্বাচলে বরাদ্দ করা হয়েছে। সম্প্রতি আরো ১ হাজার ৪৪০টি ক্ষতিগ্রস্ত ও আদিবাসীকে পূর্বাচলে প্লট দেওয়ার জন্য একটি তালিকা চূড়ান্ত করে রাজউক। এর মধ্যে ৫৪১ জন আদিবাসী। অন্যরা সাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে প্লট পাবেন।
প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যেসব সাধারণ ক্ষতিগ্রস্তের ৩১ শতাংশের বেশি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, এবার তাদের তালিকা তৈরি করেছে রাজউক। রাজউকের এই তালিকায়ও অনিয়ম এবং স্বজনপ্রীতি হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা। ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, যাদের ৩১ শতাংশের জায়গায় ৪০ শতাংশেরও বেশি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে- এ রকম ক্ষতিগ্রস্তদের নামও তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে রাজউক। অথচ তাদের চেয়ে কম জমি যাদের অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাদের নামও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে ভুক্তভোগীদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে।
গাজীপুরের কালীগঞ্জের পাড়াবর্থা মৌজার ক্ষতিগ্রস্ত আবুল হোসেন বলেন, পূর্বাচল উপশহর বাস্তবায়নের সময় তার ৪০ শতাংশেরও বেশি জমি অধিগ্রহণ করা হয়। তিনি নামমাত্র ক্ষতিপূরণের অর্থ পেয়ে ছিলেন। রাজউক কথা দিয়েছিল যে তিনি একটি প্লট পাবেন। সে অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত কোটায় তিনি প্লটের আবেদন করেছিলেন। কিন্তু রাজউক যে তালিকা করেছে, সেখানে তার নাম নেই।
একই অভিযোগ করেছেন সাইফুল ইসলাম, সাইদুর রহমান, মোকাররম হোসেন, ইনশান আলী, শিবানী রানীসহ আরো অনেকেই। ক্ষতিগ্রস্ত রোকসানা আক্তার বলেন, তার ৪৬ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। তার নামও এবার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
ক্ষতিগ্রস্ত জোসনা বেগম বলেন, তারও ৪৭ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল পূর্বাচল প্রকল্পের জন্য। তার নামও তালিকায় নেই। অথচ তার চেয়ে কম জমি যাদের, তাদের অনেকের নাম তালিকায় স্থান পেয়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, রাজউকের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী অবৈধ সুবিধা নিয়ে কম জমির ক্ষতিগ্রস্তদের নাম তালিকায় ঢুকিয়েছে। বেশি জমিওয়ালাদের নাম বাদ দিয়েছে।
অবশ্য এ প্রসঙ্গে প্লট বরাদ্দ দেয়ার নাম চূড়ান্ত করার দায়িত্ব পালনকারী কমিটির সদস্য ও রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক বলেন, দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ মিথ্যা। বিষয়টি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, প্রত্যেকটি আবেদনপত্র ও তাদের কাগজপত্র আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করেছি। যাদেরটা বাদ গেছে, কোথাও না কোথাও তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। কোথাও দেখা গেছে, আবেদনপত্রে স্বাক্ষর নেই। আবার কোথাও দেখা গেছে এফিডেভিটে স্বাক্ষর নেই। অনেকের সম্পর্কে ডিসি অফিস থেকে নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে। অনেকে একবার রাজউকের প্লট পেয়েছেন। কিন্তু অন্য জায়গার জমির বিপরীতে আবারও প্লটের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু একজনকে একটির বেশি তো প্লট দেওয়ার নিয়ম নেই।
প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক আরো বলেন, এবার ১ হাজার ৪৫৩ জনের নামের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছিল। সর্বশেষ যাচাই-বাছাই করার সময় আরও ১৩টি আবেদনে ভুল ধরা পড়ল। এখন ১ হাজার ৪৪০ জনকে প্লট দেয়া হবে। তাদের কারোরই ৩১ শতাংশের কম জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি।
জানা যায়, ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জে ৬ হাজার ১৫০ একর জমিতে বাস্তবায়ন শুরু হয় পূর্বাচল উপশহর প্রকল্প। এ জন্য প্রায় ২০ হাজার মানুষের জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ইতোমধ্যে প্রায় ২৫ হাজার প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে মাত্র এক-চতুর্থাংশ ব্যক্তি রাজউকের প্লট পেয়েছেন। বাকিরা পাননি। উপরন্ত রাজউককে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল সিন্ডিকেট।
বরং সরকারের পূর্বাচল প্রকল্পকে ঘিরে বহু বছর ধরে দুর্নীতি শুরু হয়েছে। যা ডাল-পালা ছড়িয়ে আজ বিষ বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। আর এর অবৈধ সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন রাজউকের একশ্রেণীর দুর্নীতি পরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারী। রাতারাতি অবৈধ অর্থে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে তারা। অনিয়মগুলোই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এসব দেখারও কেউ নেই।

 

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

দুর্ঘটনার আশঙ্কায় জনমনে উদ্বগে বীরগঞ্জের সড়কগুলো দাপিয়ে বড়োচ্ছে কিশোর চালকরা

সন্দ্বীপে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা উদ্বোধন