নিজস্ব প্রতিবেদক : রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবির বহির্প্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ বপিত হয়েছিল বহু আগে। অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী।
বদরুদ্দীন উমর ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (তৃতীয় খ-) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ১৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একটি চিঠি গোপনে পাচার হয়ে আসে। তাতে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান এবং বরিশালের মহিউদ্দীন আহমেদ নিজেদের মুক্তির জন্য জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘট শুরু করেছেন। এই সংবাদের সঙ্গে চিঠিতে রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করার অনুরোধ জানানো হয়।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। কিন্তু পাকিস্তানের দুটি অংশ-পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিরাজ করছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ব পাকিস্তান অংশের বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলে বাংলা ভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি বেআইনী ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
বদরুদ্দীন উমর তাঁর গ্রন্থে বলেন, ১৮ ফেব্রুয়ারির ওই চিঠি পাওয়ার পরই ১৯ ফেব্রুয়ারি বন্দীদের মুক্তির দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্র সভা আহ্বান করা হয়। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন মুখলেছুর রহমান। সভায় যারা বক্তৃতা দেন তাদের মধ্যে ছিলেন জিল্লুর রহমান, নাদিরা বেগম ও শামসুল হক চৌধুরী। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দীন আহমেদসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করে প্রস্তাব গ্রহণ ছাড়াও ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাজবন্দী মুক্তি আন্দোলন কমিটি’ নামে একটি কমিটিগঠন করা হয়। এই কমিটি গঠনের কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বদলি হয়ে যান। ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন হায়দার নামে প্রবীণ একজন অফিসার। এ বিষয়ে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তৎকালীন সম্পাদক মোহন মিয়ার বক্তব্য হলো, ‘ফরিদপুর জেলা বোর্ডের নির্বাচন উপলক্ষে ফরিদপুর রওনা হই। রাত দশটা/এগারোটার দিকে আমি নূরুল আমিনের বাড়ি হয়ে যাই। সেই সময় ভাষা আন্দোলন নিয়ে নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা করি। ছাত্ররা বড় ধরনের গ-গোল করতে পারে। এ বিষয়েও কথা হয়। এর পরই নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) ১৪৪ ধারা অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুসংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অমান্যের অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, শফিউল, সালাম, বরকতসহ আরও অনেকে। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তান মুসলিম লীগের সম্মেলন উপলক্ষে পল্টন ময়দানে আয়োজিত জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন দম্ভের সঙ্গে আবারও ঘোষণা করলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রজনতা নাজিম উদ্দিনের এই ঘোষণা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন। ৩১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশনকে সামনে রেখে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ভাষা দিবস ঘোষণা করে সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল ডাকা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মাইকযোগে পূর্ববঙ্গ সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারির কথা ঘোষণা করে। ১৪৪ ধারা জারি করার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রসমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর নবাবপুর আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা আরম্ভ হয়। অলি আহাদ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রসংসদের সভাপতি গোলাম মাওলা, আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পর জোরালো বক্তব্য রাখেন। এঁদের সমর্থন করেন ফজলুল হক মুসলিম হল ইউনিয়নের সহসভাপতি শামসুল আলম।
ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন বলেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর কেটে গেছে কয়েক দশক। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। একুশের পথ ধরেই আমরা একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, স্বাধীন হয়েছি। এখন ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ আন্তর্জাতিক পরিসরেও উদ্যাপন হচ্ছে মাতৃভাষা দিবস। ভাষার জন্য সারা পৃথিবীতে আমাদের গর্ব ছড়িয়ে রয়েছে। আমাদের মতো খুব কম জাতিকেই তাঁদের মাতৃভাষার জন্য লড়াই করতে হয়েছে। এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য গৌরবের। পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানীরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল।
শাসকদের সব চক্রান্ত রুখে বাঙালী সেদিন নিজের অধিকার আদায় করে নিয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের অনেক অর্জন আছে। দুঃখজনক হলো, একষট্টি বছরেও সর্বস্তরে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা চালু হয়নি। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাভাষার মুক্তি ঘটে সত্য। তবে এখনও এ ভাষার যথেষ্ট ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাভাষা নিয়ে যথাযথ গবেষণা হচ্ছে না। ভাষাসৈনিকদের যথাযথ মূল্যায়নও এদেশে হয়নি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মতো ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসও বিকৃত হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে একুশের প্রভাতফেরি সংস্কৃতি।
আমি ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র আহ্বায়ক। সে জন্য আন্দোলনের ব্যাপারে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয় আমাকে। বায়ান্ন সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের একটি সভা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের ছাত্ররা তাতে অংশ নেন। সভায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকও উপস্থিত ছিলেন। সভায় সব ছাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলনের পক্ষে মত দেন।