সুমন মেহেদী : ‘টেকসই উন্নয়ন-সমৃদ্ধ দেশ, নিরাপদ খাদ্যের বাংলাদেশ’ স্লোগান নিয়ে গত ২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ কোভিড-১৯ এর স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে পালিত হয়েছে ‘জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস ২০২১’। উল্লেখ্য যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা দিবস ১৮ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করবেন। প্রতিটি প্রাণীকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত খাদ্য খেতে হয়। সুস্থ ও সবলভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। তাই খাদ্যের উপাদান ও নিরাপদতা সম্পর্কে সকলেরই কিছু না কিছু সাধারণ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে মহিলাদের খাদ্যের পুষ্টি ও নিরাপদতা সম্পর্কে জানা দরকার, কারণ আমাদের দেশে মায়েরাই সন্তানকে লালন-পালন করে থাকে।
নিরাপদ খাদ্যের অধিকার প্রতিটি মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। জনগণের এ অধিকার প্রতিষ্ঠায় খাদ্য মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত, ভেজালমুক্ত ও নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের আমলে পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স, ১৯৫৯ রহিত করে ২০১৩ সালে যুগান্তকারী ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ প্রণয়ন করা হয় এবং ২ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সালে এ আইনের আওতায় একটি জাতীয় বিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে ‘বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ গঠন করা হয়। আইনটির রূপকল্প হলো- ‘জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্য’। আইনটি প্রণয়নের উদ্দেশ্য- “বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণে খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয় সংশ্লিষ্ট সকল কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ এবং এ লক্ষ্যে একটি দক্ষ ও কার্যকর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা”।
খাদ্যের নিরাপদতার মান নিয়ন্ত্রণে একটি কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী সংস্থা হিসেবে সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি-বেসরকারি অংশীজনের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে সংস্থাটি খাদ্যে ভেজালরোধে সচেতনতামূলক প্রচারণাসহ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, খাদ্যের নিরাপদতা ও গুণগত মান পরীক্ষণ, নিরাপদতার মান অনুসারে রেস্তোরাঁর গ্রেডিং প্রদান ও নিয়মিত মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ২০১৯ সালে দেশের বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেডিং পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়। ভোক্তা ও ভোজনরসিকদের স্বার্থে ‘এ+’, ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’, এই চার ক্যাটাগরিতে তালিকাভুক্ত করা হয় ঢাকা মহানগরীর হোটেল-রেস্তোরাঁকে। গ্রেডিং সিস্টেমের আওতায় খাবারের মান, বিশুদ্ধতা, পরিবেশ, ডেকোরেশন, মনিটরে রান্নাঘরের পরিবেশ দেখা যাওয়ার ব্যবস্থা ও ওয়েটারদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ভিত্তিতে রেস্তোরাঁগুলোকে চার ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব বিচারে ৯০ নম্বরের বেশি স্কোর হলে সবুজ বর্ণের স্টিকার ‘এ+’, স্কোর ৮০ এর উর্ধ্বে হলে নীল বর্ণের স্টিকার বা ‘এ’, ৫৫ থেকে ৭৯ পর্যন্ত স্কোর হলে হলুদ বর্ণের ‘বি’ এবং ৪৫ থেকে ৫৫ স্কোর হলে কমলা বর্ণের ‘সি’ ক্যাটাগরি পাবে। ‘এ+’ এর মানে রেস্তোরাঁটি উত্তম, ‘এ’ মানে ভালো, ‘বি’ মানে গড়পরতা ভালো এবং ‘সি’, মানে গ্রেড পেন্ডিং। ভবিষ্যতে দেশব্যাপী সকল রেস্তোরাঁগুলোকে এই গ্রেডিং এর আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি গত ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে হোটেল ও রেস্তোরাঁ মনিটরিং সংক্রান্ত ‘নজর অ্যাপস’। সেদিন ‘নজর অ্যাপসে’র মাধ্যমে রাজধানীর নবাবী ভোজ রেস্তোরাঁর দুটি আউটলেট ও ফার্স রেস্তোরাঁয় মনিটরিং কার্যক্রম দেখেন উপস্থিত খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এবং বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ। এই ‘নজর অ্যাপস’ এর মাধ্যমে রেস্তোরাঁ-হোটেলের রান্নাঘরের কর্মকাণ্ডসহ প্রতিটি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা যাবে। পাশাপাশি খাদ্যের নিরাপদতা ও গুণগতমান পরীক্ষণের জন্য দেশের ৬টি বিভাগে ৬টি ল্যাবরেটরি নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও ঋঅঙ এর সহযোগিতায় একটি মোবাইল ল্যাবরেটরি ভ্যানের কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। কার্যক্রমে গতি আনার লক্ষ্যে ২০২০ সালে নব নিয়োগপ্রাপ্ত ৯৫জন কর্মকর্তার মধ্যে ৬৪জনকে ৬৪ জেলায় নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। তাদের মাধ্যমে জেলা অফিস চালু করে নিরাপদ খাদ্য মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
বৈশ্বিক দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজির একটি অন্যতম সূচক হলো ২০৩০ সালের মধ্যে সকল মানুষ, বিশেষ করে অরক্ষিত পরিস্থিতিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী, দরিদ্র জনগণ ও শিশুদের জন্য বিশেষ অগ্রাধিকারসহ বছরব্যাপী নিরাপদ, পুষ্টিকর ও পর্যাপ্ত খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। এই প্রত্যয়কে সামনে রেখেই বর্তমান সরকার প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ ও ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জনগণের নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস নেয়া হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক অত্যন্ত সচেতনতার সাথে পুষ্টি সংবেদনশীল দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ পরিকল্পনা (ঈওচ) বাস্তবায়ন কাজ মনিটরিং করা হচ্ছে। জনসাধারণের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের অঙ্গীকার পূরণে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
দেশের দরিদ্র জনগণের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন খাদ্য অধিদপ্তর হতে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় প্রতি কেজি চাল ১০টাকা মূল্যে ৫০ লক্ষ পরিবারকে মাসে ৩০কেজি করে বছরে ৫ মাস (মার্চ, এপ্রিল, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর) প্রদান করা হচ্ছে। এ খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে ২.৫ কোটিরও বেশি মানুষ সরাসরি উপকৃত হচ্ছে। মহামারি কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ায় ২০২০ সালে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে অতিরিক্ত একমাস (মে, ২০২০) চাল বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি অতি দরিদ্র জনগণের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচি ও ভিজিডি কর্মসূচির আওতায় দেশের ২২০টি উপজেলায় ৬ ধরনের অনুপুষ্টি সর্মদ্ধ ‘পুষ্টিচাল’ বিতরণ করা হচ্ছে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে ১০০টি উপজেলায় পুষ্টি চাল বিতরণ করা হয়েছে এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে আরো ৫০টি উপজেলা অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে এ কর্মসূচি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। খাদ্যের উৎপাদন হতে শুরু করে খাবার টেবিল পর্যন্ত প্রতিটি স্তর তথা উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ, সরবরাহ, বিপণন প্রতিটি পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে খাদ্যের পুষ্টিমান ও নিরাপদতার গুরুত্ব পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ লক্ষ্যে সকল অংশীজনসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করা হচ্ছে। ভেজাল খাদ্য রোধে জনসচেতনতা সৃষ্টিকল্পে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সারাদেশে সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে জেলা-উপজেলায় সভা, সেমিনার, কর্মশালা, সিম্পোজিয়াম, পাবলিক মিটিং, লিফলেট, পোস্টার, বুকলেট, স্টিকার, প্যাম্পলেট বিতরণসহ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা এবং টিভি স্পট তৈরি পূর্বক বিভিন্ন টিভি-চ্যানেলে প্রচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়াও জেলা পর্যায়ে ক্যারাভান শো’র মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে উন্নত এবং একটি সুস্থ-সবল জাতি গঠনে এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সিনিয়র তথ্য অফিসার, খাদ্য মন্ত্রণালয়