নিজস্ব প্রতিবেদক: কবি সুফিয়া কামাল ‘এমন আশ্চার্য দিন’ কবিতায় লিখেছেন- ‘আশ্চর্যা এমন দি মৃত্যুতে করে না কেহ শোক/মৃত্যুরে করে না ভয়, শঙ্কাহীন কিসের আলোকে উদ্ভাসিত ক’রে তোলে ক্লান্ত দেহ, মুখ, পদক্ষেপ/সংকল্পের দ্যুতি তরে দৃঢ়তার প্রচার প্রলেপ করেছে ভাস্বর’।
১৯৫২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ‘পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকা’ মাতৃভাষা বাংলাকে সমর্থন করে একটি সম্পাদকীয় ছাপে। ওইদিনই পত্রিকাটির সম্পাদক আব্দুস সালাম ও প্রকাশক হামিদুল হক চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল মতিন জানিয়েছেন, ভোটাভুটির শেষে আবুল হাশিম সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পূর্বে আব্দুল মতিন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে, যেহেতু ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা বা ভঙ্গ না করার বিষয়টি পরের দিন ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঘটবে এবং সেইদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় ছাত্র সমাবেশ হবে। সেহেতু সিদ্ধান্ত হয় উক্ত সমাবেশ মুলতবি রাখাই সমীচীন হবে। ভাষা সৈনিক গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে ছাত্ররা যখন অনড় থাকে, তখন অধ্যাপক আবুল কাসেম ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ছাত্রদের মত সমর্থন করেন। রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে পৃথকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের পর পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরাই পাকিস্তান সরকারে প্রাধান্য পায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তান সরকার ঠিক করে উর্দু ভাষাকে সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা করা হবে। যদিও পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু ভাষার চল ছিল খুবই কম। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষ (যারা সংখ্যার বিচারে সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন) এ সিদ্ধান্তকে মোটেই মেনে নিতে চায়নি। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর খাজা নাজিমুদ্দিন জানান, পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া হবে। এ ঘোষণার পর মাতৃভাষা আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে ওঠে। পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে মিটিং-মিছিল ইত্যাদি বেআইনী ঘোষণা করে। কিন্তু শাসক গোষ্ঠীর কোন কিছুই সেদিন বাংলার ছাত্রজনতা মানেনি। মায়ের ভাষা রক্ষার দাবিতে রাস্তায় নেমে পড়েন।
১৯৫০ সালে ৭ ডিসেম্বর মৌলানা আকরম খানের নেতৃত্বে গঠিত ১৬ সদস্যবিশিষ্ট ঊধংঃ ইবহমধষ খধহমঁধমব ঈড়সসরঃঃবব আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবকে বাস্তবতা বিবর্জিত এবং উদ্ভট হিসেবে আখ্যায়িত করে চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রদান করে। এই কমিটি রিপোর্টে পূর্ব পাকিস্তানের অফিস আদালত ও শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বতভাবে বাংলা ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল।
একই সালের ১০ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তির পর পরই ভাসানী ইচঈ রিপোর্ট (যাতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করা হয়েছিল) প্রত্যাখ্যান করেন এবং এৎধহফ ঘধঃরড়হধষ ঈড়হাবহঃরড়হ এ গৃহীত প্রস্তাবগুলো অবিলম্বে মেনে নেয়ার জন্য পাকিস্তান সরকারকে আহ্বান জানান।
১৯৫১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের জন্ম। এই যুবলীগ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পাশাপাশি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া মুসলিম সংস্কৃতির পরিবর্তে পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি যেমন, পহেলা বৈশাখ, নবান্ন ইত্যাদি চর্চার ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ ছিল। যুবলীগ মূলত পাকিস্তানের প্ল্যান-ইসলামিক মতবাদ থেকে বেরিয়ে এসে পূর্ব-বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চার ক্ষেত্রে একটি কণ্ঠস্বর হিসেবে নিজেদের অল্পদিনের মধ্যে পরিচিত হয়ে ওঠে।
১৯৫১ সালের ১১ মার্চ ঞযব উযধশধ টহরাবৎংরঃু ঝঃধঃব খধহমঁধমব গড়াবসবহঃ ঈড়সসরঃঃবব পূর্ব বাংলার সব পত্রপত্রিকায় এবং গণপরিষদের সদস্যদের মাঝে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে একটি স্মারকলিপি পাঠায়।
একই সালের ২৭ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পুনরায় গণপরিষদে আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবটি পেশ করে। উল্লেখ্য, মৌলানা আকরম খানের নেতৃত্বে গঠিত ১৬ সদস্যবিশিষ্ট ঊধংঃ ইবহমধষ খধহমঁধমব ঈড়সসরঃঃবব আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবকে বাস্তবতা বিবর্জিত এবং উদ্ভট হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করলেও সেই রিপোর্টকে সাধারণ জনগণের সামনে প্রকাশ করেনি পাকিস্তান সরকার। ততদিনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের এদেশীয় সদস্যদের মধ্যেও অনেকে বাংলার পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এ রকমই একজন হাবিবুল্লাহ বাহার এ্যাসেম্বলিতে এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। হাবিবুল্লাহ বাহারের সঙ্গে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই প্রস্তাবকে পূর্ব-বাংলার জনগণকে শিক্ষা ক্ষেত্রে পঙ্গু করার জন্য একটি দূরভিসন্ধি হিসেবে অভিহিত করে এই প্রস্তাব বাতিল করার দাবি জানান। পূর্ব বাংলার সংসদ সদস্যদের একাংশের তীব্র বিরোধিতার মুখে প্রস্তাবটি প্রত্যাহারে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার।
১৯৫১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর এ সময় ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল আব্দুল মতিনের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই, সেপ্টেম্বর, অক্টোবরে পৃথক পৃথক সমাবেশ করে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় সমাবেশগুলোতে কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, গাজীউল হক প্রমুখ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঞযব ইধংরপ চৎরহপরঢ়ষবং ঈড়সসরঃঃবব ড়ভ ঃযব ঈড়হংঃরঃঁবহঃ অংংবসনষু ড়ভ চধশরংঃধহ পুনরায় উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে এ্যাসেম্বলিতে চূড়ান্ত নির্দেশনা প্রদান করে।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকা সফররত পাকিস্তানের তৎকালীন গবর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানের সমাবেশে ঘোষণা করেন কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সঙ্গে সঙ্গে সমাবেশ স্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সেøাগান উঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। এই বক্তব্য সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পরের দিন ২৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। এ সমাবেশ থেকে নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদকে পশ্চিম পাকিস্তানের হাতের পুতুল হিসেবে অভিহিত করা হয়। ৩০ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য ভাষা আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দান করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এইদিন সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। একই দিন মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভাসানীর নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি আওয়ামী মুসলিম লীগের সরাসরি এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৩১ জানুয়ারি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে পূর্ব-পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবীদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন থেকে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে।
১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ডাকে ঢাকা শহরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় একটি মিছিল নিয়ে রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি ডাকা সাধারণ ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সব সভাসমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারির পরিপ্রেক্ষিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এর উদ্যোগে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত সদস্যগণ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার ব্যাপারে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সভার একটি বড় অংশ ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার ব্যাপারে মত দিলেও অনেকেই এতে সহিংসতার আশঙ্কায় বিপক্ষে মত দেন।
বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (তৃতীয় খ-) গ্রন্থে লিখেছেন, পাকিস্তান শাসক শ্রেণী কর্তৃক ভাষা নিপীড়ন ও বাংলাদেশের জনগণের সংস্কৃতি দমন নীতি এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার নীতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মধ্যযুগীয় মুসলমান শাসকের উদারণনীতির উল্লেখ করে বলেন, ‘শাসকদের এ ঐতিহ্য হইতে শিক্ষণীয় কিছু ছিল। হুসেন শাহ, পরগান খাঁ, ছুটি খাঁ ও অন্যান্য বহু খাঁন জানান, পাঠান নৃপতিগণ ইহা হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন যে রাজত্ব স্থায়ী করিতে হইলে দেশের ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা উচিত।