যশোর প্রতিনিধি : বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে অসাধু ব্যবসায়ী আর মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে বিলুপ্তির পথে সম্ভাবনাময় কলারোয়ার টালিশিল্প। যশোরের বেনাপোলের কলারোয়ার টালি বিদেশে রফতানি করে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে দর্ঘিদিন ধরে। সম্ভাবনাময় এই খাত এক নম্বরে থাকলেও আজ তা ধ্বংসের দ্বারে উপনীত। পেশা হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার মালিক ও শ্রমিকরা। দেশের প্রায় সবক্ষেত্রেই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও টালি কারখানা আধুনিক না হওয়া, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, সরকারের সুদৃষ্টির অভাব ও সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়া এই শিল্প ধ্বংসের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে, এখনো হাতে গোনা কয়েকজন এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কলারোয়ার মুরারীকাটি গ্রামের প্রয়াত রামকৃষ্ণ পালের ছেলে গোষ্ট চন্দ্র পাল। তিনি বলেন, ১৯৪৭ সাল থেকে আমরা টালি তৈরি করি। পূর্বপুরুষরা এ শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। লেখাপড়ায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করা সত্ত্বেও গোষ্ট চন্দ্র পাল পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন। তিনি বলেন, ২০১৯ সালে বিদেশে টালি রপ্তানি করে কারখানা মালিকরা আয় করেন ১২-১৩ কোটি টাকা। দেশের অর্থনীতির বিকাশে এটি একটি বড় অবদান বলে মনে করেন তিনি। গোষ্ট চন্দ্র পাল বলেন, এখানে প্রায় ৪০টি টালি কারখানায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৪ হাজার শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। বছরে ৬ থেকে ৭ মাস টালি তৈরি ও বিক্রি হয়। সাধারণত অক্টোবর মাস থেকে শুরু হয় টালি তৈরির মৌসুম। চলে মে-জুন পর্যন্ত। বর্ষাকালে টালি তৈরি করা যায় না। সাধারণত তিন ধরনের টালি তৈরি করেন তারা। তারমধ্যে ছাদের টালি, দেওয়াল টালি ও মেঝের টালি অন্যতম। নকশা ও সাইজের উপর ভিত্তি করে এসব টালি আবার ২০-৪০ প্রকার হয়ে থাকে। সব মিলিয়ে ১২০ প্রকার প্রকার টালি তৈরি হয় এ পল্লীতে। একেকটি টালির একেক রকম নাম। তাদের মধ্যে স্কয়ার। রেকট্যাংগুলার, স্টেপ টাইলস, হেক্সা গোনার, স্কাটিং প্রভেন সালেহ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। প্রতি পিস টালির দাম ৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। স্কয়ার টালি সাধারণত দেয়ালের শোভা বর্ধনে ঘরের চালের ছাউনিতে ব্যবহার করে থাকে বিদেশিরা। ঘরের মেঝে সাজানোর জন্য রয়েছে ফুলের আকারে প্রভেনসালেহ। প্রতি পিস প্রভেনসালের দাম ২৫-৩০ টাকা। এভাবে একেকটি টালির নকশা, গঠন ও আকার অনুযায়ী দামের হেরফের রয়েছে। দাম কম হলেও এগুলোর সৌন্দর্য, গুণমান ও স্থায়িত্ব অতুলনীয়। ঘর সাজানোর জন্য শিল্পীরা তৈরি করেছেন সার্কেল টাইলস। ৪টি সার্কেল টাইলস নিয়ে একটি সেট। এক সেটের দাম ৪০-৫০ টাকা। গোষ্ট চন্দ্র পাল আরো বলেন, সাতক্ষীরার মাটির তৈরি এসব টালি মংলা বন্দর দিয়ে দুবাই ও ইউরোপে রপ্তানি করা হয়। দুবাই থেকে আবার কিছু টালি প্রসেসিং হয়ে আমেরিকার বিভিন্ন দেশে যায়। বর্তমানে ফ্রান্সের বাজার ধরার চেষ্টা চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো মেশিন বা যন্ত্র ছাড়াই কারিগররা তাদের সুনিপুণ হাতে মাটি দিয়ে তৈরি করেন এসব টালি। তৈরিকৃত টালি রোদে শুকানোর পর চুল্লিতে পোড়ানো হয়। ১৬ ঘণ্টা বিশেষ নিয়মে চুল্লিতে জ¦াল দিতে হয়। হেরফের হলে টালির আকার আকৃতি ও পোড় কম বেশি হয়। এতে টালির মান ভালো হয় না। সাধারণত মাসে একবার একটি চুল্লিতে টালি পোড়ানো হয়। তিনি বলেন, সরকারি সাহায্য সহযোগিতা ও পৃষ্টপোষকতা পেলে এ শিল্প থেকে সরকার কোটি কোটি টাকা আয় করে দেশের অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনে এ শিল্প উন্মোচন করতে পারে সম্ভাবনার নবদিগন্ত। টালি শিল্পের বিকাশে কিছু প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এলাকার কারখানা মালিকরা ঐক্যবদ্ধ নয়। ফলে একেক মূল্য। মহাজনরা বাকিতে টালি কিনে সময়মত বিল শোধ করে না। কলারোয়া উপজেলার মুরারীকাটি ও শ্রীপতিপুর এলাকায় প্রথমে টালি উৎপাদন শুরু হয়। পরে আশেপাশের আরো কয়েকটি গ্রামে পর্যায়ক্রমে ৪০টি কারখানা গড়ে উঠলেও তা এখন কমে মাত্র ১০-১৫টিতে দাঁড়িয়েছে। ২০০০ সালের দিকে কলারোয়ায় টালি নির্মাণ শুরু হয়। সেসময় রাফাইলো আলদোঁ নামে এক ইটালিয়ান ব্যবসায়ী অসেন বাংলাদেশে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তিনি নারায়ণগঞ্জে টালি তৈরির কাজ শুরু করেন। কিন্তু সেখানকার মাটি টালি তৈরির উপযুক্ত না হওয়ায় তিনি দেশে ফিরে যান। রাফাইলো আলদোঁ ফিরে গেলেও তার বাংলাদেশি প্রতিনিধি রুহুল আমিন দেশের বিভিন্ন স্থানে টালি তৈরির জন্য মাটি খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি সাতক্ষীরার কলারোয়ায় এসে পেয়ে যান টালি তৈরির উপযোগী মাটির সন্ধান। তখন কলারোয়ায় শুধুমাত্র ছাউনির কাজে ব্যবহৃত টালি (স্থানীয় নাম ‘খোলা’) তৈরি করা হতো। মূলত তিনি এই টালি দেখেই বুঝতে পারেন এখানকার মাটি দিয়েই রপ্তানিযোগ্য টালি তৈরি সম্ভব। তাই ‘কারার এক্সপোর্ট ইমপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড’র মালিক রুহুল আমিন কলারোয়ার পালদের পোড়া মাটি দিয়ে তৈরি রপ্তানিযোগ্য টালির সম্ভাবনার গল্প শোনান। সেই সূচনা। এরপর থেকে শুরু হয় বিভিন্ন নকশার টালি তৈরি। প্রথম দিকে এখানকার টালি ইতালিতে রপ্তানি হতো। এ কারণে কলারোয়ার এ এলাকা ধীরে-ধীরে ‘ইতালিনগর’ এবং পোড়া মাটির টালি ‘ই-টালি’ নামে পরিচিত হতে থাকে। প্রথমদিকে বাংলাদেশে এই টালি শুধুমাত্র ঘরের ছাউনিতে ব্যবহার করা হলেও ইতালিতে এই টালি ঘরের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য ছাদের উপর ছাড়াও ঘরের মেঝে ও দেয়ালেও ব্যবহার করা হতো। বাড়ির সৌন্দর্যবর্ধণে ব্যবহৃত এই ‘ই-টালি’ অল্পদিনেই নজর কাড়ে জার্মান, দুবাই, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে। জাহাজে করে রপ্তানি শুরু হয় এসব দেশে। মংলা সমুদ্র বন্দর দিয়ে কলারোয়ার মাটির তৈরি টালি রপ্তানি হতে থাকে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। তবে টালি রপ্তানির সেই যুগ এখন শুধুই স্মৃতি। আগে যেখানে বছরে ৪০০ কন্টেইনার রপ্তানি করা হতো এখন তা হয় একশ’। কমে এসেছে টালির দামও। মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে ছোট টালি প্রতি পিস পাঁচ টাকা থেকে আট টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যার উৎপাদন খরচও প্রতি পিস সাড়ে পাঁচ টাকা। অন্যদিকে, বড় টালি প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ৫০-১০০ টাকা দরে যা প্রতি পিস উৎপাদন খরচ প্রায় ৪৫-৯০ টাকা। আর অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে ক্ষদ্র-ক্ষুদ্র কারখানা মালিকরা এই টালি ব্যবসা থেকে সরে পড়ছেন। টালি কারখার শ্রমিক ফতেমা খাতুন বলেন, এই শিল্প আমাদের রুটি রুজির উৎস। টালি ছাটাই, ব্রাশ করা, তোলা, রং করার কাজ করি। দিনে মজুরি হিসেবে পাই মাত্র ২০০ টাকা। এর উপরেই কোনোরকমে বেঁচে আছি। টালির কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে আমরাও শেষ হয়ে যাব-বলেন ফতেমা খাতুন। একই কথা বলেন শ্রমিক রুহুল আমিন। তিনি বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টালির কারখানায় কাজ করে পাই ৪০০ টাকা। খুব কষ্টে সংসার চলে। টালির কারখানা না থাকলেও আমরা কীভাবে বেঁচে থাকব। টালি কারখানা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ ইমাদুল ইসলাম জানান, তারাসহ বেশ কয়েকজন এ ব্যবসাটা ধরে রেখেছেন। প্রতি কন্টেইনার টালির উৎপাদন খরচ প্রায় ১ লাখ টাকা। ইউরোপের বাজারে যার দাম ২ লাখ টাকা। বছরে প্রায় ৪০০ কন্টেইনার টালি রফতানি করে শত শত কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব এই শিল্প থেকে। টালি ক্রেতা সাতক্ষীরা পল্লী চেতনা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, কলারোয়ার টালি শিল্প সাতক্ষীরা জেলার ঐতিহ্য। টাইলসের চেয়ে টালির গুণগত মান অনেক ভালো। টালি একশ’ বছর পর্যন্ত অক্ষত থাকে। এতে সহজে নোনা ধরে না। দামও কম। টিকে বেশিদিন। দেখতেও চমৎকার। কিন্তু এটি এখন বিলুপ্তির পথে। এই শিল্পকে রক্ষা করা দরকার।