নিজস্ব প্রতিবেদক : সরকার রাজধানী উপর গাড়ির চাপ কমাতে ঢাকার চারদিকে আউটার রিং রোড ও সার্কলার রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। ওই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগ আউটার রিং রোড বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। জাপান ১৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ ৮ লেনের রিং রোড নির্মাণে আগ্রহী হওয়ায় পিপিপিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকার জাপানের সঙ্গে জি-টু-জি চুক্তি করেছে। আশা করা হচ্ছে আগামী ২০২৮ সালের মধ্যে ওই সড়ক চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া সম্ভব হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। আর প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রাজধানীবাসী পদ্মা সেতুর কাঙ্খিত সুফল পাবে। পাশাপাশি রাজধানীর যানজট কমাতে সার্কুলার রেল নেটওয়ার্কও গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে মেগা ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে ৬ বছর লাগবে এবং সম্ভাব্য ব্যয় হবে ৮ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে একদিকে যেমন রাজধানী ঢাকার মানুষ খুব স্বাচ্ছ্যন্দে চলাচল করতে পারবে, পাশাপাশি রাজধানীর পাশের জেলাগুলো থেকেও মানুষ খুব সহজে রাজধানীতে আসতে পারবে। সার্কুলার রেললাইন রাজধানীর চারপাশে রিং আকারে হওয়ার পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জকে যুক্ত করে এর দৈর্ঘ্য হবে ৮০ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার। ইতিমধ্যে চীন এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং সওজ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রিং রোড প্রকল্পের প্রথম পর্বে সাভারের হেমায়েতপুর থেকে কেরানিগঞ্জের মদনপুর পর্যন্ত ৮ লেনের ৪৮ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। তার মধ্যে বর্তমানে চার লেনের ১২ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। তার সঙ্গে আরো ৪ লেন নতুন সড়ক নির্মাণ করা হবে। বাকি ৩৬ কিলোমিটার সড়ক জমি অধিগ্রহণ করে সম্পূর্ণ নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। ৮ লেন বিশিষ্ট ওই সড়কের প্রস্থ হবে ২৪০ থেকে ৩০০ ফুট। ওই অংশে ২টি রেস্ট এরিয়া, ৫টি ইন্টারচেঞ্জ, ৬টি ব্রিজ, ২০টি ওভারপাস এবং আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। ৩৬ কিলোমিটার সড়ক নতুন করে নির্মাণ করতে ৩৮৪ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। আর এ অংশের কাজ শেষ করতে ব্যয় হবে ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে প্রকল্পের সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রণয়নের কাজ শেষ হয়েছে। আর দ্বিতীয় পর্বে ৮৪ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্তকরণ এবং উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যমান সড়কের মধ্যে ৪৮ কিলোমিটার ২ লেন এবং ৩৬ কিলোমিটার ৪ লেন করে রয়েছে। ওসব সড়ক ৮ লেনে উন্নীত করা হবে। তাছাড়া সরু ব্রিজগুলো ভেঙে ৮ লেন বিশিষ্ট করা হবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ইন্টারচেঞ্জ, ওভারপাস, আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। তবে এ অংশের উন্নয়ন কাজ কিভাবে সম্পন্ন করা হবে সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। মূলত ঢাকাবাসীকে পদ্মা সেতুর কাঙ্খিত সুবিধা নিশ্চিত করতেই আউডার রিং রোড বাস্তবায়ন জরুরি। ওই কারণে জোরেশোরে তৎপরতা চালাচ্ছে সওজ। সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ব্যাপারে নিবিড় মনিটরিং করা হচ্ছে। আগামী ২০২৮ সালের মধ্যে প্রকল্প উন্মুক্ত করার পরিকল্পনায় সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আর বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালিত হলে নির্ধারিত সময়েই প্রকল্পটি চালু করা সম্ভব হবে।
সূত্র জানায়, সার্কুলার রেল প্রকল্পটির সম্ভাব্য রুট ধরা হয়েছে বিশ্ব ইজতেমা মাঠ থেকে উত্তরা, ঢাকা চিড়িয়াখানা, গাবতলী, মোহাম্মদপুর, সদরঘাট, পোস্তগোলা, ফতুল্লা, চাষাড়া, আদমজী, ডেমরা, ত্রিমহনী, পূর্বাচল ও টঙ্গি। রেল রুটটিতে থাকবে ২৪টি স্টেশন, যার মধ্যে ১১টিতে থাকবে মেট্রো রেল, বাস সার্ভিস, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের সাথে অভ্যন্তরীণ রুট বদলের সুবিধা। তার মধ্যে ১০ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক হবে আন্ডারগ্রাউন্ডে আর বাকি পথ হবে এলিভেটেড। ২৪টি স্টেশনের মধ্যে আন্ডারগাউন্ডে ৩টি স্টেশন হবে। বাকি ২১টি স্টেশন হবে এলিভেটেড। সার্কুলার রেল রুটটির দুটি ডিপো থাকবে। এর মধ্যে একটি ডেমরায়, অন্যটি ত্রিমহনী। চীন ইতোমধ্যে ওই মেগা প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করে শিগগিরই খসড়া জমা দেয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদনের খসড়া রোডস এন্ড হাইওয়ে ডিপার্টমেন্ট (আরএইচডি), ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ), বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআইডব্লিউটিএ) এবং ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডসহ (ডিএমটিসিএল) অন্যান্য সংস্থাগুলোর কাছে তাদের মতামত জানার জন্য জমা দেয়া হবে। প্রকল্পটির সম্ভাব্য ব্যয় হবে ৭১০ বিলিয়ন টাকা। সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো একসাথে এই কাজ বাস্তবায়নে ফান্ড সংগ্রহ করবে। মূলত ঢাকা এবং এর পার্শ্ববর্তী জেলা যেমন গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও টাঙ্গাইল জেলার কর্মজীবী ও ব্যবসায়ীদের দৈনন্দিন চলাচল ও আগমনে সুবিধার জন্য সরকার এই সার্কুলার রেল নেটওয়ার্ক সুবিধা গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
সূত্র আরো জানায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে সার্কুলার রেল নেটওয়ার্কও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এমন ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ঢাকায় একদিকে যেমন যানজট নিরসন হবে, পাশাপাশি সড়ক যোগাযোগের ওপর চাপ অনেকাংশে কমে যাবে। কারণ এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে শহরের ভেতরে প্রবেশ না করেই একজন যাত্রী রাজধানীর এক প্রান্তে থেকে অন্যপ্রান্তে যেতে পারবে। আবার যারা শহরের মধ্যে প্রবেশ করতে চাইবে তাদের জন্য থাকছে ইন্টারচেঞ্জ স্টেশন। যেগুলোতে মেট্রোরেল, র্যাপিড বাস ট্রানজিটসহ অন্যান্য সুবিধা ব্যবহার করে তারা সহজেই শহরে প্রবেশ করতে পারবে। বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৫ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে এবং ব্যস্ত সময়ে শহরের সড়কগুলোতে যানবাহনের গড় গতি কমে দাঁড়াচ্ছে ৫ কিলোমিটার। এসব কারণে বার্ষিক প্রায় ২০ হাজার কোটি থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। সরকার সার্কুলার রেল নেটওয়ার্ক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীনের একটি ফার্ম দিয়ে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। তাতে ২০টি স্টেশনসহ ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ নেটওয়ার্কের এই প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ রেলওয়ে ২০১৯ সালের এপ্রিলে এই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে চীন-বাংলাদেশ যৌথ ভ্যাঞ্চার কোম্পানির উদ্যোগে ২৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। যৌথ ভ্যাঞ্চার কোম্পানিতে থাকা কোম্পানিগুলো হচ্ছে- চায়না রেলওয়ে সিচুয়ান সার্ভে এন্ড ডিজাইন গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড এবং দুটি লোকাল ফার্ম- বিইটিএস কনসালটিং সার্ভিস লিমিটেড এবং ইঞ্জিনিয়ারস এন্ড এডভাইজারস লিমিটেড। সম্মিলিত এই কাজ এক বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে তা বিলম্বিত হয়।
এদিকে আউটার রিং রোড প্রকল্প বিষয়ে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি প্রফেসর ড. আকতার মাহমুদ জানান, পদ্মা সেতু এবং ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের কারণে গোপালগঞ্জ, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, বরিশাল এলাকার উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ সম্ভাবণাগুলো কার্যকরভাবে কাজে লাগানো গেলে ওই এলাকার মানুষ ঢাকামুখী হবে না। প্রয়োজন থাকলে দিনে দিনে ঢাকায় এসে কাজ শেষ করে তারা আবার চলে যাবে। সেজন্য ঢাকার কেরানিগঞ্জসহ আশপাশের এলাকাকে ঘিরে রিং রোড করার যে পরিকল্পনা রয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য এ রিং রোডটি বাস্তবায়ন করাও খুবই জরুরি।
অন্যদিকে সার্কুলার রেল নেটওয়ার্ক প্রসঙ্গে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. শামসুল হক জানান, বিলম্বিত হলেও ভালো উদ্যোগ। তবে এমন ধরণের প্রকল্পের কার্যকারিতা নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। বিশেষ যথাযথভাবে ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা, অন্যান্য ট্রান্সপোর্ট মোডের সাথে যথাযথভাবে সমন্বয় সাধন করা এবং কার্যকরভাবে তা পরিচালনা করা।
সার্কুলার রেল নেটওয়ার্ক প্রকল্পের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মনিরুল ইসলাম ফিরোজ জানান, রেলওয়ের প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে তা খুব শিগগিরই রেলমন্ত্রীর উপস্থিতিতে একটি সভায় প্রেজেন্টেশন আকারে উপস্থাপন করা হবে। আর সকলের মতামত গ্রহণের পরই ওই প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হবে। আর ওই সভার পরই প্রকল্পের পরিপূর্ণ ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপোজাল (ডিপিপি) প্রস্তুত করা হবে।