নিজস্ব প্রতিবেদক : শীতের মৌসুম এলেই এক সময়ে গ্রাম-বাঙলার ঘরে ঘরে খেজুরের রস দিয়ে ফিরনি, পায়েস, রসের গুড় দিয়ে ভাঁপা পিঠা এবং গাড় রস তৈরি করে মুড়ি, চিড়া, খই ও চিতই পিঠাসহ হরেক রকম পিঠাপুলির মহাউৎসব চলত। কিন্তু আগের মতো গ্রাম্য রাস্তার দুপাশে সারি সারি খেজুর গাছ আর নেই। গ্রামের রাস্তাগুলো সংস্কার ও নতুন করে খেজুর গাছ রোপণে মানুষের আগ্রহের অভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ও খেজুরের রস ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এখনও রাস্তার আশপাশে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু খেজুর গাছ। আর রস আহরণে এখনো গ্রাম্য রীতিতেই ঝুঁকি নিয়েই কোমরে রশি বেঁধে শীতের বিকালে ছোট-বড় মাটির হাঁড়ি গাছে বেঁধে তা থেকে রস সংগ্রহ করছেন গাছিরা। আগে তারা এই কাঁচা রস এলাকার বিভিন্ন স্থানে ও হাটবাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। আবার কেউ কেউ সকালে রস জ¦াল দিয়ে গুড়-মিঠাই তৈরি করতো। প্রতিবছর এই মৌসুমে খেজুর গাছের রস ও গুড় বিক্রি করে দুটাকা বাড়তি আয় করতো তারা। গাছি আবদুল হক মিয়া বলেন, রাস্তাগুলো সংস্কার হওয়ার কারণে খেজুর গাছ কেটে ফেলা হলেও নতুন করে আর কেউ গাছ লাগাচ্ছে না। হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে হাতেগোনা কয়েকটি খেজুর গাছ রয়েছে। উপজেলার নুরপুর ইউনিয়নের সুতাং এলাকার আবদুল হক মিয়া একসময় শীত এলেই গাছি হিসেবে কাজ করতেন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে বিক্রি করতেন খেজুরের রস। এখনো তিনি ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন। তিনি জানালেন, ব্রিজের কাছের গাছে তিনি কলস লাগিয়েছেন, বিকেলের দিকে গাছে কলস লাগালে সারারাতেই তা ভরে উঠে। আব্দুল হক মিয়ার কাছ থেকে খেজুরের রস কিনতে এসেছেন মোস্তফা জামান হৃদয় ও ইসমাইল হোসেন এলিন। ইসমাইল হোসেন এলিন জানান, অনেকদিন পর খেজুরের রসের সন্ধান পেয়েছি। এ রস দিয়ে পায়েস খুব পছন্দ, তাই বাসার জন্য এক জগ কিনে নিয়েছি। রসওয়ালা দাদুকে খুশি হয়ে দুইশ টাকা দিয়েছি। মোস্তফা জামান হৃদয় বলেন, ‘আসলেই খেজুর রসের স্বাদ ভোলার মত নয়। তৃপ্তিভরে খেজুরের রস খেলাম, বেশ ভাল লাগছে। কিন্তু সচরাচর খেজুরের রস পাওয়া যায় না, সরকারিভাবে এসব গাছ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া দরকার’। শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় আগে অনেকেই শীত মৌসুমে খেজুরের রস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু এখন খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এখন এ পেশায় মানুষ কাজ করে না। উপজেলার শৈলজুড়া গ্রামের খিরাজ মিয়া একসময় পুরো শীত মৌসুমে খেজুরের রস বিক্রি করতেন। কিন্তু তিনিও বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় আর খেজুর রস না পাওয়ায় এ পেশায় নেই। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কারণ নতুন করে খেজুর গাছ রোপণে মানুষ আগ্রহী হচ্ছে না। এ বিষয়ে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুকান্ত ধর বলেন, খেজুর গাছ এবং এর রস ঐতিহ্যগতভাবে বাংলার সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে। খেজুর রস এবং রস থেকে তৈরি গুড় বাংলার পিঠা উৎসবের মূল অনুসঙ্গ। বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে অনেকে বাণিজ্যিকভাবে সৌদি খেজুরের বাগান করছেন। কিন্তু তার পরিমাণও অনেক কম।